আবীর আহাদ


মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এজন্যই প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে অধ্যায় সেটি ছিলো সর্বাত্মক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, যা বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর সেই সর্বাত্মক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের রূপকার হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ। এখানে 'মুক্তিযুদ্ধ' হলো কর্ম এবং 'মুক্তিযোদ্ধা'রা হলো কর্মী।

কর্মীদের ঐতিহাসিক কর্মের স্বীকৃতি তাদের মৌলিক অধিকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অর্থাত একটা আইনগত স্বীকৃতির মাধ্যমে কর্ম ও কর্মীর সম্মান প্রদর্শনের প্রশ্ন এখানে জড়িত। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি, এ ঐতিহাসিক কর্ম তথা অবদানের আইনগত স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার অবশ্যই আমাদের রয়েছে।

আমাদের বাংলাদেশ যেহেতু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হয়েছে, সে কথাটা নিশ্চয়ই আমাদের জাতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিপিবদ্ধ থাকাই বাঞ্ছনীয় ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক সত্য এই যে, সংবিধানের মূলস্তম্ভ 'প্রস্তাবনা'র কোথাও মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা শব্দ বলতে কিছু নেই!

যেমন সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: "আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি" এখানে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেই কথাটা নেই! এটাও মানুষ জানে, সংগ্রাম যেখানে শেষ, যুদ্ধ সেখানে শুরু। অর্থাত্ সংগ্রামের পথ পরিক্রমা যুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এবং বাংলাদেশে সেটিই হয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের তাঁর ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যে সংগ্রাম নয়, 'যুদ্ধ' চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধ মানেই মুক্তিযুদ্ধ, যেটির সাংবিধানিক স্বীকৃতি আমরা দাবি করে আসছি। সংগত কারণে এখানে বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণাটি তুলে ধরা হলো, যথা:

"এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানে আছো, এবং যার কাছে যা আছে, তাই নিয়ে, শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্যবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।" : শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ-৭১ প্রথম প্রহর, ধানমন্ডি ঢাকা।

সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: "আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে"। এখানে বীর জনগণ ও বীর শহীদদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও "বীর মুক্তিযোদ্ধা" বলতে যে আরেকটা সম্প্রদায় রয়েছে, তাদের অবদানের কথা বলাই হয়নি; স্বীকৃতি তো দূরের কথা!

আমাদের বদ্ধমূল ধারণা, ১৯৭২ সনে তাড়াহুড়ো করে সংবিধান রচনা করার কারণে হয়তো 'মুক্তিযুদ্ধ" ও 'মুক্তিযোদ্ধা' প্রসঙ্গ সন্নিবেসিত হয়নি। আমরা চাই জাতীয় ইতিহাসের স্বার্থে "মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা" শব্দ দু'টিকে সংবিধানের যথাস্থানে সংযোজন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখা হোক।

"মুক্তিযুদ্ধ" প্রসঙ্গটি সাংবিধানিক আইন দ্বারা সংরক্ষিত নয় বলে স্বাধীনতাবিরোধী ও মতলববাজচক্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে ইতিহাস ও জনসমক্ষে মুক্তিযুদ্ধের মহিমা ও মর্যাদাকে হালকা করে দেখানোর লক্ষ্যে ৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধকে গণ্ডগোলের বছর, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ইত্যাকার অপমানজনকভাবে চিত্রিত করে আসছে। যেমন সংবিধানদৃষ্টে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামী কুখ্যাত আলবদর নেতা মাওলানা আলী আহসান মুজাহিদ ৭ম জাতীয় সংসদ ও আইসিটি আদালতে দম্ভভরে বলেছিলেন, বাংলাদেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি! অপরদিকে সাংবিধানিক আইন দ্বারা "মুক্তিযোদ্ধা" শব্দটি সুরক্ষিত না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কহীন যে কেউ, এমনকি রাজাকাররাও যখন তখন অর্থ, আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে "মুক্তিযোদ্ধা" বনে যাচ্ছে। মূলত: মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির অর্থ দেশের সংবিধানের আইন বলে রাষ্ট্র কর্তৃক এসবের ঐতিহাসিক জাতীয় মর্যাদা ও সম্মান সংরক্ষিত থাকবে। এর মাধ্যমে ইতিহাস ও জনমনে এসবের ঐতিহাসিক তাৎপর্য গুরুত্ব পেতে থাকবে। সাংবিধানিক আইন বলে "মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা" সংরক্ষিত থাকলে কেউ কোনোদিন কোনোকালে "মুক্তিযুদ্ধে"র ইতিহাস বিকৃতি এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়ে "মুক্তিযোদ্ধা" নামের অমর্যাদা করার দু:সাহস দেখাতে পারবে না। এর ইতিহাস বিকৃতি ও মর্যাদা বিতর্কিত করা হলে সেটি হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের সামিল, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

আগেই বলেছি, প্রতিটি মানুষ তার কর্মের স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখেন। জীবনের জন্য যেমন আহার বস্ত্র বাসস্থান চিকিৎসা ও শিক্ষার প্রয়োজন, তেমনি জাতীয় প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক অবদান রাখার আইনগত স্বীকৃতি পাওয়াও তার আরেকটা মৌলিক অধিকার। সে তাঁর জাতীয় কীর্তি ধরার বুকে রেখে যেতে চায়। এ চাওয়ার পশ্চাতে তাঁর কোনো আর্থিক লাভ নেই সত্য, কিন্তু তারচেয়ে বড়ো এটাই যে, তার মান মর্যাদা ও সম্মানটাই তাকে মহিমান্বিত করে। এটা একটা আত্মতৃপ্তি ও আত্মগরিমার প্রশ্ন, যার মধ্যে বাঙালি জাতির শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বের প্রশ্ন জড়িত। আর মানুষের প্রকৃতি এই যে, সে তার আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকতে চায়। সে নিরিখেই জাতীয় ইতিহাসের স্বার্থে "মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা" এসবের সাংবিধানিক স্বীকৃতি একান্ত অপরিহার্য।

স্বাধীনতাবিরোধী ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির কোনো গুরুত্ব নেই; আছে একরাশ বিরক্তি। তাদের অনেকেই যখন অর্থ আত্মীয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে, তারা এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চায় না। কারণ এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করলে তারা বিপদে পড়ে যেতে পারে। যেমন অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ইতিমধ্যে ধরাশায়ী হয়েছে। তারা মনে করে, মুক্তিযোদ্ধা হওয়া গেছে, আর কী? মাসে মাসে ভাতা পাচ্ছি, অন্যান্য সুবিধাদি পাচ্ছি। মূলত: তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক চেতনা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মান সম্মান ও মর্যাদার কোনো মূল্ নেই। তারা "মুক্তিযোদ্ধা"র নাম ভাঙিয়ে আর্থিক লাভালাভ খুঁজতেই ব্যস্ত।

আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা জাতীয় ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে যখন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিটি তুলে এনে একটা সফল পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, ঠিক সেসময়, বিশেষ করে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গাত্রদাহের কারণে প্রশ্ন তুলছে যে, সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেলে এতে কোনো লাভ হবে কিনা? অর্থাত এর মধ্যেও মালপানির ধান্দা আছে কিনা, সেটার দিকেই তাদের লোলুপ দৃষ্টি! এখন বুঝুন, আমরা কীসব ভেজালের মধ্যে বসবাস করছি। যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার মর্ম বোঝে না, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঐতিহাসিক অবদানের সাংবিধানিক স্বীকৃতি চায় না, তারা চায় শুধু আর্থিক লাভালাভ তাদের প্রতি একরাশ ঘৃণা প্রকাশ করেই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।

এ বিষয়টি সুরাহা করার লক্ষ্যে আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ থেকে হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার যৌথস্বাক্ষরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে ৮ দফার স্মারকলিপি দিয়েছিলাম, পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের পরামর্শ অনুযায়ী সংবিধানের প্রস্তাবনার সংশ্লিষ্ট স্থানে 'মুক্তিযোদ্ধা' ও 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দ কীভাবে প্রতিস্থাপিত বা সংযোজিত হবে, সে বিষয়ে আমাদের সুপারিশ সন্নিবেসিত করেছি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় আমাদের মনে হয়েছে যে, সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। আমরাও তাই অপেক্ষার প্রহর গণে চলেছি।

লেখক : চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।