চৌধুরী আবদুল হান্নান


তিনটি ব্যাংক থেকে একটি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের নামে বের করে নেওয়া ৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা বেনামি ঋণ হিসেবে ধারনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগ (সমকাল০৩/১০/২২)। খবরে আরও বলা হয়েছে, গভর্নরের অনুমোদন পেলে এ বিষয়ে বিশদ পরিদর্শন শুরু হবে। অতঃপর জানা যাবে ঋণ হিসাবগুলো প্রকৃতই বেনামি কিনা ।

আমাদের অভিজ্ঞতায় বলে এ বিষয়ে তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখবে বলে মনে হয় না, এক সময় ধামাচাপা পড়ে যাবে। ব্যাংক থেকে এত বিপুল অর্থ যারা অবলীলায় বের করে নিতে সক্ষম হয়েছেন তাদের হাত অনেক লম্বা, তারা চুপ করে বসে থাকবেন না। আর ব্যাংক কর্মকর্তা যারা এ সব বেনামি ঋণ দেওয়ার সাথে জড়িত তাদের বড় বিপদ হবে যদি ঋণগুলো বেনামি হিসেবে প্রকাশ্যে আসে।

বিপদ যখন উভয়ের, ঋণগ্রহিতা ও ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের, তখন বিষয়টি গোপন রাখতে তারা এক হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে তদবির করবে, চাপ দেবে। ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করার নজির তো বাংলাদেশ ব্যাংকের রয়েছেই, আরও আছে অভ্যন্তরে দুষ্টচক্র আর বিভীষণেরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যখন বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের সাথে যোগসাজশ থাকার কথা পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার হতে দেখি, তখন আমাদের যারপর নেই বিস্মিত হই।

চেনা এবং বুক ফুলিয়ে চলা অর্থ আত্মসাতকারীদেরই যেখানে পাকড়াও করতে এত গড়িমস, সেখানে বেনামি বা লুকিয়ে থাকা ঋণ গ্রহীতাদের খুঁজে বের করবে কে ?

বেনামি ঋণ কী ?

নিজের নামে না নিয়ে অন্য একজনের নাম ব্যবহার করে যে ঋণ বের করে নেওয়া হয় সেটা বেনামি ঋণ, এখানে যার নামে ঋণটি সৃষ্টি হয় , তিনি ঋণের প্রকৃত উপকারভোগী নন। যারা ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে নিজের নামে নতুন করে ঋণ নিতে পারছেন না , তারা বিশ্বাসী ও একান্ত অনুগত কোনো ব্যক্তিকেবেছে নিয়ে তাঁর নামে কৌশলে ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে থাকেন। এখানে একজনের নামে দায় সৃষ্টি হলো আর ভোগ করলো অন্য একজন।

খেলাপি হয়েও কীভাবে আবার নতুন ঋণ নেওয়া যায় তা তাদের বেশ জানা, বেনামি ঋণ বের করে নেওয়ার কৌশলও তাদের নখদর্পণে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতে মোট কত টাকা বেনামি ঋণ রয়েছে তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারবে না, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও এ তথ্য নেই। বিশেষ কোনো কারণ না ঘটলে বেনামি ঋণের তথ্য প্রকাশ্যে আসে না।

ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমান নিয়েও রয়েছে বিতর্ক, ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার প্রবণতা রয়েছে যাতে ব্যাংকের স্বাস্থ্য আপাতত ভালো দেখানো যায়।

বেনামি ঋণের যে প্রকৃতি তাতে এ ভৌতিক ঋণ বিতরণের দিন থেকেই শুধু খেলাপি নয়, অপরাধমূলক খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিৎ।

স্বীকৃত খেলাপি ঋণ, অবলোপনকৃত ঋণ এবং বেনামি ঋণ একসাথে যোগ করে হবে মোট খেলাপি ঋণএবং এর পরিমান যাহা ই হোক না কেনো তা মুদ্রা বাজার ও পুঁজি বাজারে প্রবেশ করে দৈত্যের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।ফলে বাজারে মূল্যস্ফীতিসহ নানা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে যার ফলে প্রত্যক্ষ ওপরোক্ষভাবে ভুগছে দেশের মানুষ।

যারা ব্যাংকের টাকা মেরে বিলাসবহুল জীবন যাপন করে, বিদেশে অর্থ পাচার করে তারা জাতির শত্রু এবং তাদের অপ্রতিরোধ্য গতি ব্যাংক ব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। ঝিমিয়ে পড়া প্রতিকার, প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনই জোরদার করতে না পারলে সর্বনাশটা বেশি দূরে নয়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।