মোহাম্মদ ইলিয়াছ


সৈয়দ আশরাফ‌ মাত্র ১৯ বছর বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আজীবন মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা লালন করেছেন। সততা ও আদর্শের সাথে কোনরকম আপোষ করেননি। প্রতিক্রিয়াশীলতাকে কোন স্থান দেননি। অসাধারণ এক রাজনৈতিক আদর্শের পুরোপুরি চর্চা করে গেছেন। কিন্তু  কোন‌দিন কাউকে অসম্মান করে কথা বলেননি। এমন‌কি বিরোধী দলকেও না।

আমাদের রাজনীতিকে ঘিরে নানা কথা রয়েছে, কেউ রাজনীতিকে করেছে অপরিচ্ছন্ন আবার কেউবা একে করেছে মহিমান্বিত। আমাদের স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে আগামীর উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে। আর আগামীর উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে বাঙ্গালি জাতি পেয়েছে এক স্বাধীন মানচিত্র। আর জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে।

দেশ যখন সমূহ সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলেছে; ঠিক তখনই গতানুগতিক রাজনীতির ধারাকে বদলে দেয়া কোটি জনতার আস্থার প্রতীক তারুণ্যের অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তান মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অদৃশ্য এক জগতে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁর এই বিদায় রাজনীতি নিয়ে স্বপ্ন দেখা লক্ষ কোটি তরুণ জনগোষ্ঠীর হৃদয়কে ভেঙ্গে দিয়েছে। তিনি নিজেকে বিনির্মাণ করেছেন রাজনীতির হাতেখড়ি থেকে। একজন আশরাফ একটু একটু করে শত প্রতিকূলতার মাঝে নিজেকে হারাতে দেয়নি পার্থিব জগতের লোভ লালসা, পুঁজিবাদী দর্শনের কাছে। আমাদেও বর্তমান রাজনীতিতে খুবই কমসংখ্যক রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া যাবে যারা আপাদমস্তক শুধু মানুষের জন্য রাজনীতি করছেন।

সৈয়দ আশরাফ কেন অনন্য? উনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মুজিব বাহিনীর একজন লড়াকু সৈনিক। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম একজন কাণ্ডারি। যার অনুভূতি ও অস্তিত্বে রয়েছে আওয়ামী লীগের দর্শন। তিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই বারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেননি; গড়ে তুলেছেন আগামীর নেতৃত্ব।

উনার রাজনীতির একটি দর্শন হল কখনই তদবির না করা, অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা লাভ করা, কিংবা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য নিজের বলয় তৈরি করা –এর কোন কিছুকেই আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেননি। আর এই সমস্ত কারণেই তিনি শুধু কিশোরগঞ্জের সৈয়দ আশরাফ নয় বরং গোটা জাতির নেতা হয়ে উঠেছেন। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা মনে পড়ছে আশরাফ ১৯৯৬ সালে কিশোরগঞ্জ সদর আসনে সর্বপ্রথম এমপি হওয়ার পূর্বে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী একজন এমপি ছিলেন; ঐসময় সন্ধ্যার পর বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে উনাদের ছাত্র সংগঠনের অস্ত্রেও মহড়া ছিল। শহরের সকল ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজির আতংকে জীবন যাপন করত। সরকারী এমন কোন অফিস বা দপ্তর ছিল না যেখানে দলীয় প্রভাব খাটানো হয়নি। জনাব আশরাফ এমপি হওয়ার পর কিশোরগঞ্জবাসী রাজনীতির ঐ সমস্ত অভিশপ্ত কর্মকাণ্ডের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে। তিনি টানা পাচঁবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হয়েছেন।

সৈয়দ আশরাফ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে যথেষ্ট পরিমিতিবোধ নিয়ে চলেছেন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাপ্রবাহ অনেক বৈচিত্র্যে ভরপুর। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ঘরে জন্ম নেয়া সৈয়দ আশরাফ ছাত্র রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী, মুক্তি সংগ্রামে মুজিববাহিনীর অন্যতম লড়াকু সৈনিক ছিলেন।

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে নেতিবাচক কোনো খবর নেই। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ আশরাফের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলেছেন, নীতি-আদর্শের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সৈয়দ আশরাফ। তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ইতিহাস হয়ে থাকবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দলমত নির্বিশেষে ছিল আশরাফবন্দনা। একজন রাজনীতিক কীভাবে সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেন তার প্রমাণ ছিল বিভিন্নজনের মন্তব্যে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড ও ১৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে জেলখানায় হত্যা করা হলে সৈয়দ আশরাফ সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য যুক্তরাজ্যে অবস্থান করেন। দীর্ঘ দুই দশক প্রবাস জীবনে যুক্তরাজ্যে যুবলীগের প্রতিষ্ঠা সহ বাঙ্গালী কমিউনিটির ইউথ গ্রুপের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী, বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা। দুই একটা ঘটনা প্রবাহ উল্লেখ করা যায়। ২০০৭ সালে ১/১১ পরবর্তী সরকারের সময় আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সৈয়দ আশরাফ ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

তৎকালীন সময়ে দলের বেশ কিছু সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সংস্কারবাদী মনোভাব ও মাইনাস টু ফর্মুলায় ষড়যন্ত্রেও মধ্যে সৈয়দ আশরাফ ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবার ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামীর নেতৃত্বে কিছু মৌলবাদী গোষ্ঠীর লাগাতার অবস্থান যখন দেশের স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্য হুমকি ছিলো ঠিক সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার পাশে থেকে ওই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন সৈয়দ আশরাফ। বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রেও কাঁটা বিছানো রাজনীতির পথে সৈয়দ আশরাফ তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণের মাধ্যমেই টিকে ছিলেন। তাঁর এই অসীম নেতৃত্বগুণের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পরপর দুই বার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বপালন করেছেন বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। কাজেই একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক সৈয়দ আশরাফ ব্যক্তিগত রাজনৈতিক জীবনে রাজনীতির ’তাত্ত্বিক’ অর্থ প্রতিপালন করেছেন। অর্থাৎ রাজনীতি যে কোন ভোগের বিষয় নয় জনসেবার জন্য নিজের আত্মত্যাগ তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলীয় মনোনয়ন প্রদানকালে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার সভায় বলেছিলেন, ’সৈয়দ আশরাফের নাকের ডগায় যতক্ষণ পর্যন্ত নিঃশ্বাস আছে কিশোরগঞ্জ-৩ সংসদীয় আসনে এর কোন বিকল্প নেই’। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জন্য সৈয়দ আশরাফ কতটুকু অপরিহার্য। মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীল রাজনীতির মধ্য দিয়ে সৈয়দ আশরাফ বাংলাদেশর কোটি মানুষের মণিকোঠায় ঠাই করে নিয়েছেন।

সৈয়দ আশরাফের অনুপস্থিতি আগামী প্রজন্মেও হৃদয়ে একধরণের রক্তক্ষরণ অনুভব করার পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতেও একটি ব্যতিক্রম অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। আর এই সমস্ত বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সৈয়দ আশরাফের মত মানুষের জন্য রাজনীতি করার মানসিকতা সম্পন্ন রাজনীতিবিদের শূন্যতা অনুভব করবে। তাই বর্তমান রাজনীতির রহস্যময় নেতা ও ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার অধিকারী বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সৈয়দ আশরাফদের মৃত্যু হয় না, তাঁরা চিরকাল জীবিত থাকেন তাঁদের কর্মের মাধ্যমে। সৈয়দ আশরাফ হয়তো এখন আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু তাঁর কর্ম ও আদর্শ রয়ে গেছে। সৈয়দ আশরাফের আদর্শ বুকে ধারণ করে মানুষের জন্য রাজনীতি করার মানসিকতা নিয়ে সহস্র সৈয়দ আশরাফ হয়ে উঠুক এই কামনা।

লেখক : সহকারী পরিচালক (প্রশাসন), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়।