ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


দেশে প্রতিদিন ডেঙ্গুরোগী যেভাবে বাড়ছে, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডেঙ্গুর নতুন উপসর্গ। এ বছর ডেঙ্গুরোগীদের মধ্যে নতুন যেসব উপসর্গ দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে প্রথাগত ডেঙ্গুর উপসর্গের তেমন মিল নেই। এসব উপসর্গের মধ্যে রয়েছে- ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও মাথাব্যথা। নতুন এসব উপসর্গের কারণে অনেক রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তা বুঝতে না পেরে হাসপাতালে আসতে দেরি করছেন। যে কারণে চিকিৎসা বিলম্বিত হওয়ায় তাদের অবস্থা জটিল হচ্ছে। ফলে আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর মারা যাচ্ছেন।আর বর্ষা শেষে শীত কড়া নাড়ছে দুয়ারে। আবহাওয়ার এই পরিবর্তনের মধ্যেও তীব্র আকার ধারণ করেছে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। এখন পর্যন্ত সারাদেশের ৫১ জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর মিলেছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এর পরের অবস্থানে আছে পর্যটননগরী কক্সবাজার। ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও চিকিৎসা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। অক্টোবরে এসে ডেঙ্গুর এই বাড়বাড়ন্ত একটু অস্বাভাবিক। শীত নামলেই কমে যাবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২ হাজার ৭১৬ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ২৯ হাজার ৪৬৬ জন।

তবে গত মঙ্গলবার ২৫ অক্টোবর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। ফলে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু ১১৮ জনই রয়েছে। চলতি বছরের ২১ জুন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা যায়নি। তবে ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তার মধ্যে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়।আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট গবেষক ও জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ডা. এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন- ডেঙ্গু জ্বর আমাদের কাছে অতিমারি না হলেও কোনো অংশে কম নয়। প্রতিবছর আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল সংখ্যা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করছে। আর ডেঙ্গু হলে অনেকে সকাল-বিকেল প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন বা প্লাটিলেট একটু কমতে থাকলেই আতঙ্কিত হতে থাকেন। এর কোনোই দরকার নেই। বারবার পরীক্ষা করালে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ বাড়া ছাড়া আর কোনো উপকার হয় না। আবার মেশিনে গুনলে এই সংখ্যা ভুল হতে পারে, কারণ প্লাটিলেট ক্লাম্প বা গুচ্ছ হিসাবে থাকায় মেশিন অনেকগুলোকে একটা হিসেবে ধরে সংখ্যা নিরূপণ করে।

মূলত ডেঙ্গুতে গুরুতর রক্তক্ষরণ হলে, যেমন মলের সঙ্গে রক্তপাত বা রক্তবমি হলে রক্তের বদলে রক্ত দেওয়াই উত্তম, প্লাটিলেট নয়। তা ছাড়া প্লাটিলেট সঞ্চালন খুবই ব্যয়সাধ্য ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার, এক ইউনিটের জন্য চারজন দাতাকে রক্ত দিতে হয়। সর্বত্র প্লাটিলেট পৃথক করার যন্ত্রও নেই।

সব মিলিয়ে ডেঙ্গু হলে প্লাটিলেট কমা ও প্লাটিলেট জোগাড় নিয়ে অযথা দুশ্চিন্তা ও ছোটাছুটি করবেন না। সাধারণ ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, যথেষ্ট তরল খাবার খান। ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে যেমনিভাবে ব্যক্তি সচেতন থাকতে হবে তেমনিভাবে অন্যকেও সচেতন করতে হবে।আর বাংলাদেশে ডেঙ্গু একটি পুনরাবির্ভূত রোগ হিসেবে গণ্য। সাম্প্রতিক (২০০০) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন মোতাবেক এদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিস্ফোরক পর্যায়ে আছে। ১৯৮২-৮৩ সালের মধ্যে পরিচালিত ঢাকা মহানগরের স্কুলের শিশুদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে সর্বমোট ২,৪৫৬ রক্তের নমুনার মধ্যে ২৭৮টিতে ডেঙ্গুর লক্ষণ ধরা পড়ে। ১৯৮৪-৮৬ সালে ঢাকা শহরের হাসপাতাল থেকে সংগৃহীত রক্তের ২১টি নমুনার সবগুলিতেই সংক্রমণের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল।১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসার জন্য আসা প্রায় ১১% রোগীর (২৫০ জনের মধ্যে ২৭ জন) মধ্যে ডেঙ্গু অ্যান্টিজেনের পজিটিভ অ্যান্টিবডি টাইটার ধরা পড়েছিল। ১৯৯৯ সালে ঢাকার মহাখালির স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে, বিভিন্ন জেলা থেকে পাঠানো সন্দেহজনক রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে ২৪১টির মধ্যে ৯৮টিতে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব পেয়েছিল।

উক্ত ইনস্টিটিউট প্রদত্ত বিস্তারিত তথ্যে এগুলির মধ্যে কয়েকটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরও তথ্য ছিল। ঢাকা শহরের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর অস্তিত্বের কথা জানা গেছে ২০১৯ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মৌসুমে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত রোগী কখনই হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। এমনকি এই সংখ্যা গত ১৯ বছরে দেশে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে দেশে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৪৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মোট রোগী ৫০ হাজার ১৭৬ জন।২০০২ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। সে সময় ৫ হাজার ৫১১ রোগী ভর্তি হয়েছিল। ২০০১ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমলেও ২০০২ সালে রোগীর সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।

প্রধানত এশিয়ার গ্রীষ্মমন্ডলীয় এলাকার একটি ভাইরাসঘটিত সংক্রামক ব্যাধি। ডেঙ্গু ভাইরাস গোত্রভুক্ত, যার প্রায় ৭০ ধরনের ভাইরাসের মধ্যে আছে ইয়োলো ফিভার ও কয়েক প্রকার এনসেফালাইটিসের ভাইরাস। ডেঙ্গুজ্বরের অনুরূপ একটি রোগের মহামারীর প্রথম তথ্য পাওয়া যায় ১৭৭৯ ও ১৭৮০ সালে চিকিৎসা সংক্রান্ত বইপুস্তকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতায় প্রথম ডেঙ্গুজ্বর শনাক্ত হয়। ১৮৭১-৭২ সালে এ রোগ মহামারী আকারে দেখা দেয়। ওই সময় থেকে এ রোগের প্রকোপ এ উপমহাদেশে প্রায়শই ঘটে। ১৯৩৯-৪৫ সাল থেকে গোটা মহাদেশে ১০ থেকে ৩০ বছর পর পর ডেঙ্গুজ্বর দেখা দিতে থাকে। কোনো একটি বিশেষ স্থানে বারবার ডেঙ্গুর মহামারী দেখা দিত না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বহু ডেঙ্গু ভাইরাস সেরোটাইপের সহসঞ্চালন দেখা দেয় এবং মহামারীর ঘটনা বৃদ্ধি পায়। ক্যারিবীয় অঞ্চল (১৯৭৭-১৯৮১), দক্ষিণ আমেরিকা (১৯৮০ সালের শুরুতে), প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (১৯৭৯) এবং আফ্রিকায় ব্যাপক আকারে ডেঙ্গু মহামারী দেখা দেয় যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রমের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৯৫৩-৫৪ সালে ম্যানিলায় এবং ১৯৭৫ সালের মধ্যে নিয়মিত বিরতিসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে। ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালে মহামারী আকারে রক্তক্ষরা ডেঙ্গু ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও পূর্বদিকে চীনে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর ও শক-সিনড্রম ডেঙ্গু এখন এশিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি ও শিশুমৃত্যুর একটি প্রধান কারণ। ডেঙ্গু জ্বরের বাহক মশা, চার প্রকারের ডেঙ্গু ভাইরাস ১.২.৩.৪ হলো ডেঙ্গু ও রক্তক্ষরা ডেঙ্গুর কারণ এবং এগুলি প্রতিজনীভাবেও ঘনিষ্ঠ। যে কোনো একটি সেরোটাইপ বিশেষ কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়, কিন্তু অন্য ভাইরাসগুলির বিরুদ্ধে নয়। উষ্ণমন্ডলীয় ওউপ-উষ্ণমন্ডলীয় শহরাঞ্চলীয় চক্রেই ডেঙ্গু ভাইরাস স্থিতি লাভ করে। এজন্যই শহুরে লোকদের মধ্যেই রোগটি বেশি। মানুষের আবাসস্থলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দিনের বেলায় দংশনকারী মশা এসব ভাইরাসের বাহক। কোনো কোনো অঞ্চলে অন্যান্য প্রজাতি মশাও সংক্রমণ ঘটায়। রোগীকে দংশনের দুই সপ্তাহ পর মশা সংক্রমণক্ষম হয়ে ওঠে এবং গোটা জীবনই সংক্রমণশীল থাকে।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

* ডেঙ্গুজ্বর ডেঙ্গু-ভাইরাসের সংক্রমণ উপসর্গবিহীন থেকে নানা রকমের উপসর্গযুক্ত হতে পারে, এমনকি তাতে মৃত্যুও ঘটে। সচরাচর দৃষ্ট ডেঙ্গুজ্বর, যাকে প্রায়ই ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু বলা হয়, সেটি একটি তীব্র ধরনের জ্বর যাতে হঠাৎ জ্বর হওয়া ছাড়াও থাকে মাথার সামনে ব্যথা, চক্ষুগোলকে ব্যথা, বমনেচ্ছা, বমি এবং লাল ফুসকুড়ি। প্রায়ই চোখে প্রদাহ এবং মারাত্মক পিঠব্যথা দেখা দেয়। এসব লক্ষণ ৫-৭ দিন স্থায়ী হয় এবং রোগী আরও কিছুদিন ক্লান্তি অনুভব করতে পারে এবং এরপর সেরে ওঠে।

বেশির ভাগ সংক্রমণই, বিশেষত ১৫ বছরের কমবয়সী শিশুর ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ লক্ষণহীন অথবা ন্যূনতম লক্ষণযুক্ত হতে পারে। ত্বকে স্ফোট দেখা দেয় প্রায় ৫০% ক্ষেত্রে, যা প্রথমে হাতে, পায়ে এবং পরে ঘাড়ে ছড়ায়। জ্বর চলাকালীন সময় মুখ, গলা বা বুক রক্তাভ দেখায়।ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চোখে রক্তক্ষরণ।

* রক্তক্ষরা ডেঙ্গুজ্বর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রধানত শিশুদের একটি রোগ। রক্তক্ষরা ডেঙ্গু হলো ডেঙ্গুর একটি মারাত্মক ধরন। মূল লক্ষণগুলি বয়স নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রেই অভিন্ন। এ ডেঙ্গুজ্বরের শুরুতে হঠাৎ দেহের তাপ বেড়ে যায় (৩৮০-৪০০ সে) এবং ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত চলে। রক্তক্ষরণ বা ডেঙ্গু-শক সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। এতে থাকে মাথাব্যথা, ক্রমাগত জ্বর, দুর্বলতা এবং অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশীর তীব্র ব্যথা। শ্বাসযন্ত্রের ঊর্ধ্বাংশের সংক্রমণসহ রোগটি হালকাভাবে শুরু হলেও আচমকা শক ও ত্বকের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ ও কান দিয়ে রক্তপাত শুরু হয়ে যায়। রক্তে ক্রমাগত অনুচক্রিকা কমতে থাকে এবং রক্তের বর্ধমান রক্তবিকেন্দ্রক প্রবণতা থেকে আসন্ন শকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরোগীর প্রয়োজন উত্তম সেবাশুশ্রূষা ও পর্যবেক্ষণ, কেননা উপরিউক্ত পরিবর্তনগুলি খুব দ্রুত ঘটতে পারে এবং রোগীর অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে উঠতে পারে।

* ডেঙ্গু-শক সিনড্রম এটি রক্তক্ষরা ডেঙ্গুরই আরেকটি রকমফের, তাতে সঙ্কুচিত নাড়িচাপ, নিম্ন রক্তচাপ অথবা সুস্পষ্ট শকসহ রক্তসঞ্চালনের বৈকল্য থাকে। দেহের বাইরে থেকে যকৃত স্পর্শ করা যায় ও নরম হয়ে ওঠে এবং উৎসেচকগুলিতে সাধারণত অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, তবে কদাচিৎ জন্ডিস হয়ে থাকে। অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে অব্যাহত পেটব্যথা, থেকে থেকে বমি, অস্থিরতা বা অবসন্নতা এবং হঠাৎ জ্বর ছেড়ে ঘামসহ শরীর ঠান্ডা হওয়া ও দেহ সম্পূর্ণ নেতিয়ে পড়া।মহামারী নতুন জাতের ভাইরাস ও সেরোটাইপ দেখা দেওয়ায় ডেঙ্গুর মহামারী আক্রান্ত দেশের সংখ্যা ১৯৮০ ও ১৯৯০ সালের মধ্যে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ সালের পূর্বে মারাত্মক ধরনের সংক্রমণ খুব কমই দেখা গেছে। কিন্তু ১৯৯৭ সালের মধ্যেই রক্তক্ষরা ডেঙ্গু বাংলাদেশসহ উষ্ণমন্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমন্ডলীয় দেশগুলিতে একটা স্বতন্ত্র রোগ হিসেবে বড় কয়েকটি এবং ছোট ছোট অনেকগুলি মহামারী ঘটায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। প্রতি বছর আক্রান্ত প্রায় ৫০ লক্ষ রোগীর মধ্যে অন্তত ৫ লক্ষ রক্তক্ষরা ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় যাদের একটা বড় অংশই শিশু এবং মারা যায় শতকরা প্রায় পাঁচ জন। বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর এ পুনরাবির্ভাব এবং রক্তক্ষরা ডেঙ্গু উৎপত্তির মূলে আছে নজিরবিহীন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, বিমান ভ্রমণ বৃদ্ধি, মশক দমনের অভাব এবং গত ৩০ বছরে জনস্বাস্থ্যের কাঠামোর অবনতি।

ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় কি?

প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। শুধু উত্তম বললেও কম বলা হয়। এটাই বাঁচার ভাল উপায়। করোনার এই নাকাল অবস্থায় কারো ডেঙ্গু হলে অবস্থাটা কি হতে পারে এটা যার হবে সেই বুঝতে পারবে। তবে যার হয়নি সেও চিন্তা করলে মাথা ঠিক থাকার কথা না। তাই ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে মশার প্রজনন বন্ধ করা আর মশা নির্মুলের কোন বিকল্প নাই। পানি জমতে পারে এমন কোন অবস্থাই যেন না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। সকল প্রকারের ডাবের খোসা, গাড়ির টায়ার, ভাঙ্গা বোতল, পরিত্যক্ত ফুলের টব ইত্যাদি ইত্যাদি সবই সরিয়ে ফেলতে হবে নিজ উদ্যোগেই। সরকারের একার পক্ষে ১৭ কোটি মানুষের ভাঙ্গা বোতল, গ্লাস, ডাবের খোসা, বালতি, টায়ার খুঁজে বের করা বা সরিয়ে ফেলা সম্ভব না। বাঁচতে হলে যার যার নিজ উদ্যোগেও এগুলোতে অংশগ্রহন করতে হবে। মনে রাখবেন, আপনার বাড়ির পাশের মশা আপনাকেই আক্রমণ করবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ঘরোয়া পরামর্শ

ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে!

* মধু: প্রতিদিন সেবনে ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

* কালিজিরা তেল: কালিজিরা বা কালিজিরা তেলকে বলে সকল রোগের মহৌষধ! তবে প্রতিদিন ৩ চা চামচের বেশি খাওয়া ঠিক নয়! আগে কখনো না খেয়ে থাকলে আধা চামচ করে শরীরে এডজাস্ট করে নিতে পারেন! যে কোনো পেশেন্ট ও গর্ভবতী মহিলা সেবনের আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিন

*নিমের তেল: বাড়িতে মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে পানির সাথে নিমের তেল মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।এছাড়া ১০-১৫ ফোটা নিম তেল আধা কাপ নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে গায়ে লাগালেও মশারা আর ধারে কাছে ঘেঁষবে না।

* নারকেল তেল: নারকেল তেল গায়ে লাগালে মশারা কাছে ঘেষে না ।

* হলুদের গুড়ো: হলুদের মধ্যে প্রোটিন, ভিটামিন, খনিজ লবণ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, লোহা প্রভৃতি নানা পদার্থ রয়েছে। তাই হলুদ খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিদিন দুধ বা পানির সাথে হলুদের গুঁড়ো বা রস মিশিয়ে খাওয়া অভ্যাস করলে অনেকটাই সুস্থ থাকা সম্ভব। হলুদ সাধারনত বিভিন্ন রান্নায় পরিমাণমতো ব্যবহার করা হয়! তা ছাড়া সরাসরি সেবন করা যায়, তবে অবশ্যই মাত্রাতিরিক্ত নয়! পেশেন্ট, বিভিন্ন ওষুধ সেবনকারী ও গর্ভবতী মহিলারা সেবনের আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

* দুধ,কলা, ডিম: এগুলোকে সুষম খাদ্য বলা হয়! প্রতিদিন সেবনে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হয় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে! অনেকের এসকল খাদ্যে এলার্জি থাকে অথবা বিভিন্ন রোগ (যেমনঃ কিডনি রোগ, ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স ইত্যাদি) এ দুধ একটি নিষিদ্ধ খাদ্য।

* পেঁপে এবং পেঁপে পাতা: পেঁপে খুব দ্রুত রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ বাড়াতে সক্ষম। মালয়েশিয়ার এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ডেঙ্গু জ্বরের কারণে রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে পেঁপে পাতার রস তা দ্রুত বৃদ্ধি করে। রক্ত প্লাটিলেটের পরিমাণ কমে গেলে প্রতিদিন পেঁপে পাতার রস কিংবা পাকা পেঁপের জুস পান করুন।

* ড্রাগন ফল: ড্রাগন ফলে আছে প্রচুর এন্টিওক্সিডেন্ট! এটি ব্লাডের সাদা সেল (WBC) বাড়াতে সাহায্য করে।
* মিষ্টি কুমড়া এবং কুমড়া বীজঃ-মিষ্টি কুমড়া রক্তের প্লাটিলেট তৈরি করতে বেশ কার্যকরী। এছাড়াও মিষ্টি কুমড়াতে আছে ভিটামিন এ যা প্লাটিলেট তৈরি করতে সহায়তা করে। তাই রক্তের প্লাটিলেটের সংখ্যা বাড়াতে নিয়মিত মিষ্টি কুমড়া এবং এর বীজ খেলে উপকার পাওয়া যায়।

* লেবু: লেবুর রসে প্রচুর ভিটামিন সি থাকে। ভিটামিন সি রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে সহায়তা করে। এছাড়াও ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে তোলে। ফলে প্লাটিলেট ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা পায়।

* দেশী মাছ: দেশি বিভিন্ন মাছ (যেমনঃ কই, শিং, মাগুর, শোল, বাইন, ছোট মাছ, পাঁচ-মিশালী মাছ ইত্যাদি) শরীরে রক্ত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

করণীয়

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে উচ্চ তাপমাত্রা রোধ করতে শরীর ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুছে দিতে হবে। শরীর বেশি ঠাণ্ডা মনে হলে খাবার স্যালাইন দিতে হবে। হেমোরেজিক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। তাকে পূর্ণ বিশ্রামে রেখে বেশি করে পানি খেতে দিতে হবে।

হোমিও প্রতিবিধান

রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা.হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে ডেঙ্গুরোগ সহ যে কোন জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা সম্ভব-অভিজ্ঞ চিকিৎসক গন যেই সব মেডিসিন প্রাথমিক ভাবে ব্যবহার করে থাকেন, একোনাইট, বেলেডোনা, ব্রায়োনিয়া, রাসটক্স, ইউপেটেরিয়াম পার্ফ, আর্সেনিক এলবাম, কার্বোভেজ, ইপিকাক, সালফার সহ আরো অনেক ঔষুধ লক্ষণের উপর আসতে পারে, তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে বলতে চাই, ডেঙ্গু জ্বর হলে আতঙ্ক নয় জটিলতাভিত্ত্বিক চিকিৎসা করা হলে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাই ডেঙ্গুর লাভা যেন গঠিত হতে না পারে সে ব্যপারে বাড়ির চারদিকে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং নিয়মিত অভ্যাসগুলোকে মানিয়ে নেওয়ার মানসিকতা গঠন করা দরকার। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীকে সচেতন করা এবং জনসাধারণকে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা জরুরী। শহর কেন্দ্রিক সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহায়তা করা। ব্যক্তি সচেতনতার পাশাপাশি সম্মিলিত প্রয়াস গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।