মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও টাঙ্গাইলের ১৪৮টি অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। উপরন্তু ইটভাটায় জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহকৃত কাঠ। মৌসুম শুরু হওয়ায় এরই মধ্যে অধিকাংশ অবৈধ ভাটায় ইট প্রস্তুতের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

ইতোপূর্বে টাঙ্গাইল, বগুড়া, লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও জেলার অবৈধ ইটভাটার কার্যক্রম সাত দিনের মধ্যে বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট চার জেলা প্রশাসককে দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও প্রক্রিয়াগতভাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় লিখিত নির্দেশনা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৭ নভেম্বর এ সংক্রান্ত রুলের বিষয়ে আদেশ দেন।

জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২টি উপজেলার ২৮২টি ইটভাটার মধ্যে ১৩৪টি বৈধ এবং ১৪৮টি অবৈধভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। এরমধ্যে মির্জাপুরে ২৯টি, ধনবাড়ীতে ১৭টি, মধুপুরে ১৮টি, ঘাটাইলে ৪৪টি, কালিহাতীতে ১১টি, সখীপুরে ৪টি, গোপালপুরে ৩টি, দেলদুয়ারে একটি, ভূঞাপুরে ৫টি, নাগরপুরে ৮টি, সদর উপজেলায় ২টি ও বাসাইলে ৬টি ইটভাটা অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। ওইসব ইটভাটার কোনটিরই লাইসেন্স ও ছাড়পত্র নেই। জেলার ১২৩টি ইটভাটা হাইকোর্টে রিট করে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি নিয়ে চালানো হচ্ছে। হাইকোর্টের দেওয়া শর্তগুলো কাগজেই বন্দি থাকছে- বাস্তবে কোন ভাটাই তা মানছেনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লিখিত আকারে না পাওয়ায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। এরই অংশ হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তরের উদ্যোগে মির্জাপুর উপজেলার ৯টি অবৈধ ইটভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হয়েছে।

অভিযানকালে ৯টি অবৈধ ইটভাটা মালিকের কাছ থেকে এক কোটি ১৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং ভাটার কিলন ভাঙচুর ও দুই লাখ কাঁচা ইট পানি দিয়ে নষ্ট করা হয়। বুধবার(৩০ নভেম্বর) পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়জুন্নেছা আক্তারের নেতৃত্বে মির্জাপুরের আজগানা ইউনিয়নে ওই অভিযান পরিচালনা করা হয়।
কাঠের সহজলভ্যতার সুযোগ ইটভাটাগুলো পুরোপুরিই নিচ্ছে।

এছাড়া পাহাড়-টিলা এবং নদী ও বিল-ঝিলের পাশের ফলসি জমির উপরের মাটি (টপ সয়েল) এক শ্রেণির মধ্যস্বত্তভোগীদের সহায়তায় ইটভাটায় যাচ্ছে। অনেকে অতিলোভের আশায় জমির উপরের মাটি(টপ সয়েল) ইটভাটা মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন।

ধনবাড়ীর মেসার্স যমুনা ব্রিকসের মালিক আমির হোসেন জানান, ভালো ইট তৈরিতে কয়লার বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমানে কয়লার সংকট ও দাম বেশি হওয়ায় তারা কাঠ পুড়িয়ে ইট বানাচ্ছেন। বনাঞ্চলের দরপত্র হওয়া বাগান ও স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে তারা কাঠ সংগ্রহ করে থাকেন। এছাড়া কাঠের যোগান দেওয়ার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের পাইকাররা রয়েছেন, তারা চাহিদানুযায়ী কাঠ সরবরাহ করে থাকেন।

তিনি জানান, তার উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটার লাইসেন্স নাই- প্রায় সব ইটভাটায়ই কাঠ পোড়ানো হয়। তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে ইটভাটা চালাচ্ছেন। ছাড়পত্র নবায়ন না হওয়ায় হাইকোর্টে রিটের মাধ্যমে শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি নিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর ধরে ভাটা চালাচ্ছেন।

টাঙ্গাইল জেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ হায়দার খান জানান, ইটভাটায় তারা বনের কাঠ পোড়ান না। ভাটায় প্রথম চুলা জ্বালাতে কয়েক হাজার মন কাঠ দিয়ে আগুন লাগাতে হয়। অন্য সময় কয়লা দিয়েই ইট পোড়ানো হয়।

বর্তমানে কয়লার সংকট ও দাম বেশি হওয়ায় কয়লার সহজলভ্যতা এবং লাইসেন্সপ্রাপ্তির শর্তগুলো সহজতর করার দাবিতে তারা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন।

পরিবেশবাদী গবেষক সোমনাথ লাহিড়ী জানান, বনাঞ্চলের ৩ কিলোমিটার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন পুরোপুরি নিষিদ্ধ। জেলার ইটভাটগুলো স্থাপনে সে নিয়ম মানা হয়নি। প্রায় সব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়।

মধুপুর, ঘাটাইল, কালিহাতী, ধনবাড়ী ও মির্জাপুরে এর পরিমাণ বেশি। ফলে বনাঞ্চলের উপর চাপ পড়ছে, দিন দিন বন উজার হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হলেও ইটভাটা মালিকরা তা মানে না। নিজের স্বার্থে দেশের কি হলো সেটা তাদের কাছে বিবেচ্য নয়।

টাঙ্গাইলের সিভিল সার্জন ডা. মিনহাজ উদ্দিন মিয়া জানান, নিয়ম না মেনে ইটভাটা স্থাপন ও পরিচালনার জন্য আশপাশের বসতি ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। ভাটা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় তারা চোখ, ত্বক ও ফুসফুসের কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যথাযথ দূরত্ব মেনে ইটভাটা স্থাপন ও পরিবেশ রক্ষার্থে প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান জানান, প্রাথমিকভাবে ইটভাটায় আগুন লাগানোর জন্য কাঠ পোড়ানো হয়। এগুলো দেখার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। এছাড়া বন বিভাগে লোকবল কম থাকায় সব সময় সব জায়গায় পাহাড়া দেওয়া বনরক্ষীদের জন্য কষ্টকর। সে সুযোগে কাঠচোররা অনেক সময় তৎপর হয়ে ওঠে। তবে তারা আগের তুলনায় টহল বাড়িয়েছেন ও চেকপোস্টের মাধ্যমে বনের কাঠ সরবরাহে কঠোর নজরদারী করছেন।

টাঙ্গাইল জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন জানান, ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষিদ্ধ, কয়লার ব্যবহার করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনার লিখিত আদেশ তারা এখনও পাননি। তবে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে তারা ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করছেন। গত মৌসুমে ৬৭টি ইটভাটায় এক কোটি ৭১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

এ বছর মৌসুমের শুরুতেই মির্জাপুরের ৯টি ইটভাটাকে এক কোটি ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ ইটভাটাগুলোয় তৈরিকৃত কাঁচা ইট পানি দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। অনেক ভাটার লাইসেন্স নবায়ন না থাকলেও হাইকোর্টে মামলা চলমান থাকায় সেগুলো চালু রয়েছে।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ডক্টর মো. আতাউল গনি জানান, জেলার ইটভাটাগুলো সাধারণত পরিবেশ অধিদপ্তর দেখভাল করে থাকে। তারা চাইলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়া হয়। হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা তিনি পত্র-পত্রিকায় দেখেছেন। এখনও লিখিত কোন আদেশের কপি পাননি। পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

(এসএম/এসপি/ডিসেম্বর ০১, ২০২২)