প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার


প্রত্যেকটি মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য স্বপ্ন দেখে প্রতিনিয়ত। আর সে বেঁচে থাকা হয় যেন স্বপ্নময় সে প্রত্যাশা থাকে সকলের তাই সাধ্যের সাথে সাধের মিলন ঘটানোর চেষ্টা করে। কেউ পারে কেউ পারে না। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম একটি হলো বাসস্থান। আর এই বাসস্থানের স্বপ্ন দেখাটা তৈরি হয় অর্থনৈতিক সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সকলের জন্য বাসস্থানের স্বপ্ন দেখানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যা পৃথিবীর অনেক উন্নত রাষ্ট্রের পক্ষে আজও সম্ভব হয়নি। আর তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কথা বাদই দিলাম। স্বাধীনতার সময় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এদেশকে সোনার বাংলায় রুপান্তর করা । কিন্তু সে স্বপ্ন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। পৃথিবীতে যারা গৃহহীণ তারা সবচেয়ে অসহায় এটাই বলাই চলে। যেসব লোকের গৃহ নেই তার কোন ঠিকানাই নেই এটাই বাস্তবতা। এসব গৃহহীণ লোকের চাহিদাও কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। স্বল্প আয় নিয়েই চলে তাদের জীবন। সারা পৃথিবীর গৃহহীণ লোকের সংখ্যা প্রকৃত পক্ষে কত তা কিন্তু সহজেই বলা কঠিন। তবে নিম্ন আয়ের দেশে গৃহহীণ লোকের সংখ্যা অনেক বেশি এ কথা বলা যায়। 

প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রে যথাযোগ্য মর্যাদায় বসবাস করবে এটা তার সাংবিধানিক অধিকার তবে সে অধিকার বাস্তবায়ন করার চিন্তা কেউ করেনি স্বাধীনতার এত বছর পরও। বিগত কয়েক বছর যাবত এ বৃহৎ সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের একটি বিষয়। এ বিষয়ে আলোচনার পূর্বে এর শুরু সম্পর্কে আমাদের কিছু তথ্য জানা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সাল হতে অসহায়, ছিন্নমূল, ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার পুর্নবাসনে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করেন। তাঁর এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালে শুরু হয় আশ্রয়ণ প্রকল্প। এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার পুর্নবাসন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রকল্পের উপকারভোগী নির্বাচনে ভিক্ষুক, বিধবা, বয়ষ্ক, স্বামী পরিত্যক্তা, বীরমুক্তিযোদ্ধা, নদী ভাঙ্গন কবলিত পরিবার, বিশেষ সম্প্রদায় যেমন হিজড়া, তৃতীয় লিঙ্গ, বেদে, হরিজন সম্প্রদায় ও প্রতিবন্ধী ইত্যাদি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে।

এসব বাড়ি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন প্রক্রিয়াটাকে দুশ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি ‘ক’ অন্যটি ‘খ’। “ক” শ্রেণি অর্থাৎ প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার আর “খ” শ্রেণি হলো সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমির সংস্থান আছে কিন্তু ঘর নেই এমন পরিবার। এরমধ্যে বর্তমানে ‘ক’ শ্রেণিভূক্ত প্রত্যেকটি উপকারভোগী পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি তত্বাবধানে ২শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর প্রদান করা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যারাক, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রকার ঘর ও মুজিববর্ষের একক গৃহে মোট ৫ লক্ষ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুর্নবাসন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা ও আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ। এসব মহৎ উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সত্যিকার অর্থে প্রতিটি পরিবার নতুন করে বাঁচার যেমন স্বপ্ন দেখবে তেমনি তাদের প্রাণের নতুন সঞ্চার হবে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ নয়।

উপার্জন ক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা, নারীদের জমিসহ ঘরের অর্ধেক মালিকানা দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন করা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন করা, ব্যাপকহারে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের উন্নতি সাধন করা, গ্রামেই শহরের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের যে প্রক্রিয়া তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এর অন্যতম উদ্দেশ্য। এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং উপকার সম্পর্কে বুঝাতে হলে এর সাথে জড়িত রয়েছে এবং এ থেকে যারা উপকৃত হয়েছেন তাদের বক্তব্য তুলে ধরা প্রয়োজন। তাই এ লেখায় বাস্তবায়ন কারী কর্তৃপক্ষ ও একজন উপকারভোগীর বক্তব্য উপস্থাপন করছি। তাহলে বিষয়টি সম্পর্কে আরো ধারণা আরো স্পষ্ট কবে। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা আধুনিক সুবিধা বঞ্চিত একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলই বলা চলে। এ উপজেলার সঞ্চাপুরপুর গ্রামে একসাথে একজায়গায় তৈরি হয়েছে ৩৫টি ঘর। ঘরের সাথে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা দেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ। সেখানে দেখা মিলে প্রতিবন্ধি জাহিদের সাথে যার বয়স আনুমানিক ৬০ বছর। প্যারালাইজড হয়ে চলাচলের ক্ষমতা হারিয়েছে বেশ কয়েকবছর আগে। সংসারে রয়েছে ৪ সন্তান সবাই ছোট। মাঝে মাঝে স্ত্রীকে সাথে নিয়ে ভিক্ষা করেন।

উপজেলার নলুয়াপড়া এলাকা থেকে ঘর পেয়ে এসেছেন এখানে। তার সাথে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বারবার প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করেন সেই সাথে স্থানীয় পর্যায়ে যারা ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তাদের মঙ্গল কামনা করেন কান্না জড়িত কন্ঠে। তার সাথে কথা বলে বুঝা যায় ঘরটা কত প্রয়োজন। ঈশ্বরগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হানিফা বলেন প্রধানমন্ত্রী এ উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে একটি মানুষও গৃহহীণ থাকবে না। এসব মানুষের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ যথেষ্ট কাজ করার সুযোগ রয়েছে। চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করে গৃহহীণ মানুষের একটা স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করা। ইতোমধ্যে চর্তুথ ধাপের কাজ চলমান রয়েছে। যেখানে ঘর হয়েছে সে এলাকার পরিবেশকে উন্নত করতে গিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী অফিসার হিসেবে কর্মকর্তা মোসা. হাফিজা জেসমিন জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম কাজ হলো উপকারভোগী নির্বাচন এবং খাস জমি খুঁজে বের করা। এটি এমন একটি প্রকল্প যার সাথে জাতীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমশিনার (ভূমি), প্রকৌশলী, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য, উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত রয়েছেন।

উপকোরভোগীদের আবেদন মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তারা যাচাইবাছাই করে ট্রাস্কফোর্স কমিটিতে প্রেরণ করে থাকে তারপর সভায় অনুমোদন করা হয়। এবং সেসব আবেদনের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রত্যয়ন দিয়ে থাকেন। কোন কোন জায়গায় উপর্যুক্ত খাস জায়গা না পেলে জমি ক্রয়ও করা হয়ে থাকে। এছাড়াও ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ যদি জমি দান করতে ইচ্ছুক হয় সেক্ষেত্রে এসব জমিতেও ঘর করে দেওয়া হয়ে থাকে। সমস্যাটা হলো সকল খাস জমিই ঘর করার মতো উপর্যুক্ত থাকে না সেসব জমিকে সঠিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘর বানানোর উপর্যুক্ত করে তুলতে হয়। এসব ঘর নির্মাণের জন্য নির্ধারিত ডিজাইন রয়েছে এবং ব্যয়ের পরিমাণও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সত্যিকার অর্থেই এসব জমি ও ঘর বুঝিয়ে দেওয়া একটি চ্যালেঞ্জ। তবে প্রধানমন্ত্রীর এ প্রকল্পের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখাও চাকুরি জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে থেকে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার এ প্রকল্প ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে।
এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া কারন গৃহহীণ মানুষ নির্দিষ্ট সময়েই শেষ হয়ে যাবে না। প্রতিনিয়তই বিভিন্ন কারনে মানুষ গৃহহীণ হতে পারে। তাই সরকারের এ প্রকল্প চলমান থাকবে আশা করা যায়। প্রতিদিনই উপজেলা পরিষদ চত্বরে ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কাছে ঘরহীণ মানুষের আনাগোনা চোখেপড়ার মতো এ থেকেই বুঝা যায় সাধারণ মানুষ উপকৃত হচ্ছে । তবে ঘর ব্যবহার না করার বিষয়ে ইদানিং অনেক অভিযোগ আসছে সেক্ষেত্রে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি আরো ঘর প্রদানের ক্ষেত্রে সচেতন হওয়া উচিত এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় যেন ঘর বরাদ্ধ না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।