আবীর আহাদ


গত নভেম্বর মাসের ২৯ তারিখে ঈশ্বরদী ও রাজশাহী, ৩০ তারিখে নওগাঁ, শিবগঞ্জ ও বগুড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মতবিনিময় করে এসেছি। আমার সঙ্গে ছিলেন আমাদের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা হাশেম আলী ও যুগ্ম মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ার জাহান। প্রকৃতপক্ষে মতবিনিময় সভার আনুষ্ঠানিকতা বলতে যা বুঝায় তেমনটি ছিলো না। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো তাদের স্বাধীন-করা দেশে জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা কেমন আছেন, কী তাদের মনোভাব, কী তাদের অনুভূতি ও কে কেমন কী ভাবছেন, এসব দেখা বুঝা ও ভাবনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। প্রথমেই বলে নেয়া ভালো যে, বীর মুক্তিযোদ্ধারা শারীরিকভাবে প্রায় সবাই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। বয়সের ভারে, অসুস্থতায়, সামাজিক অমর্যাদায় ও আর্থিকভাবে অনেকেই জীবনযন্ত্রণায় ভুগছেন, যা থেকে আমি ও আমরা যারা তাদের সংস্পর্শে গিয়েছি তারা কেউই মুক্ত নই।

মতবিনিময়ের উদ্দেশ্যে প্রথমেই আমরা ২৯ নভেম্বর গিয়েছিলাম ঈশ্বরদীতে। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের প্রতি ভালোবাসার যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তা ছিলো ভাবনার আতীত। সভাস্থলে যাওয়ার পূর্বে দাশুরিয়া মোড়ে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাবনা জেলার আহ্বায়ক এডভোকেট সাইফুল আলম বাবলুর নেতৃত্বে এক বিরাটসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা যেভাবে আমাদের সংবর্ধনা দিয়েছেন তাতে আমরা যার পর নাই অভিভূত হয়েছি। তারপর সভাস্থলে গিয়ে বিস্মিত হয়েছি যে, বয়স ও শারীরিক অসুস্থতা সত্বেও বিপুলসংখ্যক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে আছেন। বিশেষ করে মতবিনিময় সভা আয়োজনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বাশার বাদশা, বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিউজ্জামান, সাবেক ডিআইজি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ যে আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছেন, তা কেবলই কৃতজ্ঞতার সাথে এখন স্মরণ করা যায় কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

ঈশ্বরদীতে মতবিনিময় করে আমরা বিকেল সাড়ে ৩.০০টায় রাজশাহীর উদ্দেশ্য রওনা হই। রাজশাহীতে আমাদের কোনো শাখা নেই। তবে সেখানে বসবাসরত আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বোধহয় আগেই রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লাকে আমাদের আসার কথা বলে রেখেছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লা ক্ষণে ক্ষণে আমাকে মোবাইলে পথনির্দেশ দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছিলেন। প্রকাশ থাকে যে, এটি রাজশাহীতে আমার জীবনেরও প্রথম যাত্রা। আমরা মাগরিব নামাজের পরপরই রাজশাহীতে পৌঁছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লা তার দলবল নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমাদেরকে কামরুজ্জামান চত্বরে অবস্থিত মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক সাবেক মন্ত্রী-এমপি, রাজশাহীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক জিন্নাতুন্নেসা তালুকদারের সভাপতিত্ব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লার সঞ্চালনায় রাজশাহী মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে শুরু হয় মতবিনিময়। মুহূর্তের মধ্যে সেটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে ন'টা পর্যন্ত এ মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাবিদ প্রকৌশলী এবং আমার ব্যক্তিগত বন্ধু সাইদুল আহসান (রিয়াল আহসান) কীভাবে যেন টের পান যে আমি রাজশাহীতে এসেছি। তিনি তার গিন্নি রেইনি ভাবীকে আমাদের ডিনারের আয়োজন করতে বলে নিজেই মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হন। সভা শেষে আমরা রিয়াল আহসানের বাসায় ডিনারে সামিল হই। রেইনি ভাবী এতো যে নানান রকমের সুস্বাদু খাদ্যের আয়োজন করবেন তা ছিলো ভাবনার অতীত। রেইনি ভাবী হয়তো জানেনি যে, আমাদের পেট আগের মতো আর সাড়া দেয় না! ওদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লা আমাদের রাতে থাকার জন্যে রাজশাহীর এক বিলাসবহুল হোটেল গুলশানে নিয়ে যান। আসলে পৃথিবীতে এখনো এমন লোক রয়েছেন যারা কাউকে আতিথেয়তা দিয়ে নিজের মনে আনন্দ পান। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লা তাদেরই একজন।

৩০ নভেম্বর সকাল পৌনে আটটায় আমরা বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা উদ্দেশ্যে রাজশাহী ত্যাগ করি। যাত্রাপথে হঠাত্ নওগাঁর বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহিদুল আলম লিটুর মোবাইল ফোন এলো। তিনি রীতিমতো কৈফিয়ত তলব করে বললেন, তার গিন্নি নাকি আমার লেখার ভক্ত। তার বাড়িতে তার হাতের এক কাপ চা পান না-করে গেলে তার গিন্নি নাকি রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবেন। অগত্যা গাড়ি থামিয়ে নওগাঁতে ক্ষণিকের যাত্রা বিরতি দিতে হলো। কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত হলেন। কিছু টুকটাক কথাবার্তা হলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহিদুল আলম লিটুর গিন্নি নীলিমা ফেরদৌস ভাবীর হাতের হরেক রকমের নাস্তা ও চা পান করে দ্রুত ছুটি শিবগঞ্জের দিকে।

ঐদিন সকাল সাড়ে এগারোটার সময় আমরা শিবগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে উপস্থিত হই। বীর মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা বন্ধু আকরাম হোসেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা কানু লাল বাবু প্রমুখ আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে মতবিনিময়স্থলে নিয়ে যান। সেখানে শিবগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল বারি সরদারের সভাপতিত্বে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে শুরু হয় মতবিনিময় সভা। সভা শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা আকরাম হোসেন আমাদেরকে লাঞ্চ করাতে নিয়ে যান বগুড়া শহরের ঠ্যাঙ্গামারাস্থ পাঁচতারা 'মম-ইন' হোটেলে।

৩০ নভেম্বর বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আমরা বগুড়ার সাতমাথায় অবস্থিত জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে পৌছি। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বার প্রমুখ আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে নিয়ে যান। অতঃপর আমাদেরকে উঞ্চ সংবর্ধনা ও অভিনন্দন জানিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন বাবলুর সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচ টা পর্যন্ত সভা চলে। অতঃপর আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।

এতক্ষণ আমরা আমাদের দু'দিনের কার্যক্রম ও অন্যান্য বিষয়ে আলোকপাত করলাম। এক্ষণে কী কী বিষয়ে এ ধারাবাহিক মতবিনিময় হলো, সে বিষয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করছি।

আগেই বলেছি, জীবনের পড়ন্ত বেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শৌর্য ত্যাগ রক্ত ও বীরত্বে অর্জিত স্বাধীন দেশে হৃদয়ে কী অনুভব পোষণ করছেন, কী তাদের চাওয়া, কী তারা পেয়েছে, কী অবস্থায় তারা বাস করছেন, এসব জানা দেখা ও বুঝার জন্যে আমরা তিনসাথী এসব অঞ্চলের প্রান্তিক পর্যায়ের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে একটি সাধারণ ধারণা নিতে গিয়েছিলাম। আমাদের বাঙালি মা-বধু-কন্যারা যেমনিভাবে পাতিলে ফুটন্ত দু-একটি ভাত টিপে সব ভাতের খবর জেনে নেন, আমরাও তেমনি ২/৪ স্থানের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিশে ও আলাপ-আলোচনা করে দেশের সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক অবস্থার একটি চিত্র সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্যেই এ সফরের আয়োজন করেছিলাম।

এসব অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মতবিনিময়ের মাধ্যমে এটাই আমার ধারণা হয়েছে যে, আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গত মার্চ মাসে দেশের হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথস্বাক্ষরে যে ০৮ দফা দাবি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে পেশ করেছিলাম, সেসবকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাণের দাবি গণ্য করেন। এর বাইরে আরো কিছু দাবিদাওয়া থাকলেও ঐ ৮ দফা দাবিই তাদের মূল দাবি। আরেকটি বিষয়ে, যেটি এখানে প্রকাশ করতে আমি সঙ্কোচ ও দ্বিধা বোধ করছি, সেটা হলো, আমার ব্যক্তিগত আনন্দ, গর্ব ও সান্ত্বনা এই যে, আমি বিগত কয়েক বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব নির্ভীক কথাবার্তা লিখে আসছি, সেটি একটি বিপ্লব হয়ে দেশের সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকের মনের মধ্যে আমি গেঁথে গেছি! এটি আমি টের পেয়েছি, যখন আমাকে কাছে পেয়ে অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়েছেন, সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন, কেউ কেউ হুঁহুঁ করে কেঁদে ফেলেছেন! এটা যে একজন ব্যক্তির জন্যে কতোটা আনন্দ ও গর্বের ব্যাপার তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমাদের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের এটাই সাত্বনার কথা এই যে, আমরা আমাদের কার্যক্রম, বিশেষ করে ৮ দফা দাবি উত্থাপন করে দেশের সর্বস্তরের প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের কথা সার্থকভাবে তুলে ধরতে পেরেছি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির যে দাবিটি আমি আমার লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছি, নানা ব্যাখ্যা করেছি, সেই বিষয়টি উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধারাও এখন বুঝতে পেরেছেন, এ দাবিটিই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার একমাত্র সোপান। অন্যান্য দাবিসহ এ দাবিটি সর্বাগ্রে বাস্তবায়নের ওপর তারা সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। পরিশেষে এসব অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ প্রতিশ্রুতি ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জানিয়ে বলেছেন যে, আগামীর যেকোনো আন্দোলন সংগ্রাম ও অন্যান্য কার্যক্রম তারা আমাদের পাশে থাকবেন। আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অনাবিল ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও প্রত্যয়ের ফল্গুধারায় সিক্ত হয়ে ফিরে এসেছি নিজেদের কোলায়। এ সামান্য সফরের ফলাফলকে পাথেয় করে আমরাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও প্রত্যয় নিয়ে আমাদের আগামীর পথ রচনা করবো।

লেখক :চেয়ারম্যান, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।