দেবেশ চন্দ্র সান্যাল


বাংলাদেশের স্বাধীনতা জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করা আমার জীবনের অনন্য গৌরবোজ্জল অধ্যায়। তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  এরন আহ্বানে আমরা জীবন পণ। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলাম। আমি ২৩ জুলাই’৭১ (৬ শ্রাবন ১৩৭৮ শুক্রবার) সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এ্যাড.জনাব মো: আব্দুর রহমান সাহেবের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন নিতে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ৩১৩ টি আসনের ১৬৯ টি আসনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিরস্কশ সংখ্যা গড়িষ্ঠতা লাভ করেছিল। তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসণ চলছিল। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। আওয়ামী লীগের বিজয়ে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ষড়যন্ত্র শুরু করলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসামান্য দূর দশির্তা সম্পন্ন, প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ মানুষ। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র বুঝতে পারলেন। জাতির পিতা ধীরে চলো নীতিতে রাষ্ট্রীয় ও গণ তান্ত্রিক বিধি মেনে আন্দোলন সংগ্রাম চালাতে থাকলেন।

৩ মার্চ’৭১ ছাত্র লীগের সভায় বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা, বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক, বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের- “আমার সোনার বাংলা...” কে জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হলো। ৬ ও ১১ দফার মুল দাবী পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালিদের বৈষম্য মুলক নীতি,অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও পূর্ব পাকিস্তানের সায়ত্ত্ব শাসনের দাবী। ৭ মার্চ’ ৭১ বর্তমানের সোহরাওয়ার্র্দী উদ্যান (তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে) লক্ষাধিক জন সমুদ্রের সভায় পরোক্ষ ভাবে বাংরাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেণ। জাতির পিতা বললেন-২৩ বছরের করুন ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষ নর নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।

জাতির পিতার প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায় ধারণা করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈর শাসক যে কোন সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে সেই কারণে জাতির পিতা পরবর্তী করনীয় সর্ম্পকে ও দিক নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। তিনি বলে ছিলেন- আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তা ঘাট বন্ধ করে দিবে। আমরা ভাতে মারব আমরা পাকিতে মারবো। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। এই দিনে জাতির পিতা প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেছিলেন না। তিনি প্ররোক্ষ ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর ভাষণের মর্মা অনুসারে স্বাধীনতার ইঙ্গিত আমরা সবাই বুঝতে পেরেছিলাম। জাতির পিতা যদি এই সমাবেশে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা ঘোষনা করতেন। তা হলো পাকিস্তানি শাসক জাতির পিতাকে “বিচ্ছন্নতা বাদী” হিসেবে বিশ্বে প্রচার করতেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নিতেন। ৭ মার্চ এরপর জাতির পিতার ভাষণ ও পূর্ব পাকিস্তানের উত্তেজনা পুর্ন আন্দোলন দেখে পূর্ব পাকিস্তানে নিশংসতম হত্যা ও মানবতা বিরোধী কর্মকান্ড চালানোর পরিকল্পনায় সময় ক্ষেপন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আনা ও অন্যান্য কাজের জন্য ইয়াহিয়া ও ভূট্টো জাতির পিতার সাথে প্রহসন মূলক বৈঠক করতে থাকলেন।

৯ মার্চ’৭১ বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান আর্মির সব চেয়ে নিষ্ঠুর টিক্কা খান কে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক করে পাঠালেন। ইয়াহিয়া খান টিক্কা খান ও অন্যান্যদের দিয়ে “ অপারেশন সার্চ লাইট” পরিকল্পনা করালেন এবং অনুমোদন দিলেন। ২৫ মার্চ’৭১ বিকাল ৫-০০ টার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিশেষ বিমান যোগে পশ্চিম পাকিস্তানের চলে গেলেন। পঁচিশে মার্চ রাত সাড়ে এগারটার দিকে টিক্কা খান এর নেতৃত্বে “অপারেশন সার্চ লাইট” ইতিহাসের জঘন্যতম জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা, গন হত্যা ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কার্যাদি শুরু করলো।

পাকিস্তানি সৈন্যদের মানবতা বিরোধী কার্যাদি দেখেও শুনে ২৬ মার্চ’৭১ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। জাতির পিতা স্বাধীনতা ঘোষণায় বলেন- “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন”... দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্য টিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। জাতির পিতার স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা মধ্য রাতে ই.পি.আর এর ট্রান্স মিটার ও মগ বাজারস্থ টি এন্ড টি অফিসের ভি এইচ এফ (ভেরি হাই ফ্রি কোয়েন্সি) ওয়ার লেশের মাধ্যমে প্রথমে চট্রগ্রামে এবং পরে সারা দেশে প্রেরণ করা হয়। রাত ১টার পর জাতির পিতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্যরা বাঙালিদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে ছিল। বাঙালি সৈন্য ইপিআর ও অন্যান্যরা প্রথমে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করলেন। এই প্রতিরোধ যুদ্ধ,পরে মুক্তিযুদ্ধে রুপ নিল।

জাতির পিতার স্বাধীনতা ঘোষণাক্ষণ থেকে সাধারন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করা পরাজিত ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। তারা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের সহযোগিতা করার অঙ্গিকার করলো। তারা সারাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার বিপক্ষে দাড় করানোর জন্য শান্তি কমিটি,রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্য বাহিনী করলো। তারা ভারতের পাকিস্তান বিভক্তি করন তত্ত্ব আবিস্কার করলো। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম।

ভারতের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানি ঘাটা নামক ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং সেন্টারে আমার ট্রেনিং হয়। ট্রেনিং হলো যাহায়াত দিন ছাড়া ২১ দিনের। আমার প্রশিক্ষন হলো - থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এল.এম.জি, ষ্ট্রেনগান, হ্যান্ড গেনেড দুইঞ্চ মর্টার, মাইন, এক্সপ্লোসিভ ও অন্যানের উপর। ট্রেনিং শেষে প্রশিক্ষক শিখ সেনা ডিএস ভিলন জানালেন আমার এফ, এফ নং-৪৭৪২। আমাকে আমার সাথী রবীন্দ্র নাথ বাগচী- মো: নজরুল ইসলাম, রতন কুমার দাস ও অন্যান্যদের নিয়ে আসা হলো পশ্চিম বঙ্গের কালিয়াগঞ্জের তরঙ্গপুর নামক ৭ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে। সিরাজগঞ্জ জেলার অধিবাসীদের সমন্বয়ে ১০ জনের একটি গেরিলা গ্রুপ করা হলো। গ্রুপ কমান্ডার নিযুক্ত হলেন বেলকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের জনাব এম.এ মান্নান। ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা গ্রামের বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগর্চী আমাদের কে অস্ত্র ও গোলা বারুদ দেয়া হলো। আমরা গ্রুপ নিয়ে চলে এলাম বেলকুচি উপজেলায়। বেলকুচি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে থাকি। আজ এ গ্রামে, কাল সে গ্রামে। কোন অবস্থানেই একরাতের বেশী থাকিনা। প্রতি রাতে কমান্ডার স্যার আমাদের কে পাশ ওর্য়াড দিতেন। দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা আমরা নিজেরা পর্যায় ক্রমে আমাদের শেল্টার পাহাড়া দিতাম। তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল আওয়ামী লীগ তথা স্বাধীনতার পক্ষে।

অনেকেই বাড়িতে আমাদের আশ্রয় দিয়ে গোপন করে রাখতেন। অধিকাংশ গ্রামেই ২/১ জন করে পাকিস্তানি সৈন্যদের দালাল,পিচ কমিটির সদস্য ও রাজাকার ছিল। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ আমাদের খাবার সরবরাহ করলেও পাকিস্তানি দালালদের ভয়ে অনেকে আমাদের কে আশ্রয় দিতে সাহস পেতেন না। আবার কিছু ছিলেন নির্ভিক । তাঁরা আশ্রয় ও খাবার দিতেন। আমরা প্রতিদিন সকালে ২/৩ জনের গ্রুপ করে রেকি করতে বের হতাম। আমরা ৩ টি “হিট এন্ড রান” ও ৪ টি ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে বিজয়ী হয়েছি। আমরা সবাই ছিলাম নির্ভিক। আমাদের কমান্ডার স্যার জয় বাংলা রণধ্বনি দিয়ে ফায়ার অপেন করতেন। আমরা সবাই সমস্বরে তাঁকে অনুসরন করতাম। “জয় বাংলা” রণধবণি ছিল আমাদের একটি শক্তি শালী অনুপ্রেরনা। “জয় বাংলা” একটি অনুভূতির নাম।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার।