রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : আগামিকাল ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা ভারতের সীমানা পেরিয়ে থ্রি নট থ্রি আর এসএলআরের ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করে। ওড়ানো হয় স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা। সন্তান হারানোর বেদনা ভুলে সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সাথে রাস্তায় নেমে আসে মুক্তিপাগল আপামর জনতা। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেদিনের সাহসী সস্তানরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। পাক হানাদার ও তাদের দোসররা মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছিল। ধ্বংস করতে চেয়েছিল বাঙ্গালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। শত্রুর বুলেটের এত সব আঘাত সহ্য করেও সাতক্ষীরার সস্তানরা অন্ততঃ ২৫টি যুদ্ধের মোকাবেলা করেছিল। এরমধ্যে ১৬টি যুদ্ধ ছিল উল্লেখযোগ্য। 

মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ জানান, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ সাতক্ষীরা শহরে পাকিস্তান বিরোধী মিছিলে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করে শহীদ আব্দুর রাজ্জাককে। আর এখান থেকে শুরু হয় সাতক্ষীরার দামাল ছেলেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া। মুক্তিযুদ্ধের খরচাদি বহনের জন্য সাতক্ষীরা ট্রেজারী হতে অস্ত্র আর ন্যাশনাল ব্যাংক হতে অলংকার টাকা পয়সা লুটের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম। ৮ম ও ৯ম সেক্টরের অধীনে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং শেষে ২৭ মে সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্তে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয় । এ সময় পাক সেনাদের দু’শতাধিক সৈন্য নিহত হয়।

১৭ ঘণ্টাব্যাপী এ যুদ্ধে শহীদ হন তিন জন মুক্তিযোদ্ধা। আহত হন আরো দু’জন মুক্তিযোদ্ধা। এরপর থেমে থেমে চলতে থাকে সাতক্ষীরার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্ত হামলা। এসব যুদ্ধের মধ্যে ভোমরার যুদ্ধ, টাউন শ্রীপুর যুদ্ধ, বৈকারী যুদ্ধ, খানজিয়া যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য । এ সব যুদ্ধে শহীদ হয় ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। লাইটের আলোয় অসুবিধা হওয়ায় ৩০ নভেম্বর টাইম বোমা দিয়ে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত পাওয়ার হাউস উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভীত সন্ত্রস্ত করে ফেলে পাক সেনাদের। রাতের আঁধারে বেড়ে যায় গুপ্ত হামলা। পিছু হটতে শুরু করে পাক সেনারা। ৬ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় টিকতে না পেরে বাঁকাল, কদমতলা ও বেনেরপোতা ব্রীজ উড়িয়ে দিয়ে পাক বাহিনী সাতক্ষীরা থেকে পালিয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর জয়ের উন্মাদনায় জ্বলে ওঠে সাতক্ষীরার দামাল ছেলেরা।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামায়াতের দোসর রাজাকার, আল বদর ও আল সামসের সদস্যরা যারা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল তাদের অনেকেই বিদেশে থাকায় বিচারের রায় কার্যকর করা যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শত্রুদের গুলিতে সাতক্ষীরার যে সকল বীর সন্তান শহীদ হন তারা হলেন শহীদ আব্দুর রাজ্জাক, কাজল, খোকন, নাজমুল, হাফিজউদ্দিন, নুর মোহাম্মদ, আবু বকর, ইমদাদুল হক, জাকারিয়া, শাহাদাত হোসেন, আব্দুর রহমান, আমিনউদ্দিন গাজী, আবুল কালাম আজাদ, সুশীল কুমার, লোকমান হোসেন, আব্দুল ওহাব, দাউদ আলী, সামছুদ্দোহা খান, মুনসুর আলী, রুহুল আমীন, জবেদ আলী, শেখ হারুন অর রশিদ প্রমুখ।

সাতক্ষীরার বধ্যভূমি সংরক্ষন কমিটির সদস্য সচিব অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলুর অভিযোগ, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও সাতক্ষীরা সদরের বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি আজও। যদিও তালা ও কলারোয়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিসৌধ বানানো হয়েছে।

অযত্নে আর অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে সদরের দীনেশ কর্মকারের বাড়ির পিছনের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি ও গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন। ২০১৩ সাল থেকে তারা আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ায় সাবেক জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল দীনেশ কর্মকারের বাড়ির পিছনের বদ্ধভূমি সংস্কারে উদ্যোগী হলেও বর্তমান জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে তারা আশানুরুপ ফল পাচ্ছেন না।

মুক্তিযোদ্ধা অ্যাড. মোস্তফার নুরুল আলম বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও সংরক্ষণ করা হয়নি সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে দীনেশ কর্মকারের জমিতে থাকা বধ্যভূমি বেদখল হতে বসেছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা গণকবরগুলি সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি।

কলেজ শিক্ষক নিত্যানন্দ সরকার বলেন, আগামি প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত করতে অবিলম্বে জেলার সকল বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করতে হবে।

সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোঃ হুমায়ুন কবীর বলেন, বর্তমানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কোন কমিটি নেই। তাই ৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা মুক্ত দিবস উদযাপনের জন্য জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যৌথভাবে নানা কর্মসুচি হাতে নিয়েছে। এদিকে দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠণ বিভিন্ন কর্মসুচি হাতে নিয়েছে।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ০৬, ২০২২)