শিতাংশু গুহ


নূর হোসেন-এর কথা সবার জানা। আশি’র দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে  “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” বুকে-পিঠে একথা লিখে ঢাকার রাস্তায় পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারায় নূর হোসেন। আমরা তখন দৈনিক বাংলারবানী পত্রিকায়। সন্ধ্যায় প্রত্যক্ষদর্শী সিটি এডিটর তোজাম্মেল আলী বর্ণনা করেন, কিভাবে পুলিশ টার্গেট করে নূর হোসেনকে হত্যা করে।

এরশাদ-র পতন ঘটে। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন। তারপর শেখ হাসিনা। ১৯৯৬-তে বেগম জিয়া ক্ষমতা ছাড়তে চাইলেন না, ২০০৬-এ একই দৃশ্য। জাতি ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন দেখলো, ক্ষমতায় থাকার জন্যে সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের চেষ্টা হলো। ফখরুদ্দিন-মঈন সরকার এলো। ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলা এলো। জাতি মানলো না, এরপর নির্বাচন ২০০৮। ব্যাপক সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো।

গণতন্ত্র এলোনা। ক্ষমতায় থাকাকালীণ ফখরুদ্দিন-মঈন নিউইয়র্কে এসেছিলেন, ডিনারে জেনারেল মঈন বললেন, ‘আমাদের দেশের গণতন্ত্র হবে, আমাদের ষ্টাইলে’। জাতি বিএনপি’র গণতন্ত্র দেখেছে, আওয়ামী লীগের গনতন্র দেখেছে। আরো আগে জাতি আইয়ুব খানের গণতন্ত্র, জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র দেখেছে। গণতন্ত্র কিন্তু ‘সোনার হরিণ’-ই রয়ে গেছে।

১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। বিএনপি এদিন ঢাকায় ‘মহাসমাবেশ’ ডেকেছে। এনিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত। ১৫টি দেশের দূতাবাস ও হাইকমিশন এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠূ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গুরুত্ব পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। বিবৃতিতে জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারের কথাও বলা হয়েছে।

ইতিমধ্যে ‘শান্তিপুরী বাংলায়’ কেউ কেউ বলেছেন, দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী নয় বলেই বিদেশীরা কথা বলার সুযোগ পায়। কথাটি স্পষ্ট করে বললে দাঁড়ায় যে, দেশে গণতন্ত্র নেই বলেই এমনটি হয়। এরআগে জাপানী রাষ্ট্রদূতের কথায় যে ঝাঁজ ছিলো, তা ‘হজম’ করতে কষ্ট হয়েছে বৈকি। এরমধ্যে নুতন করে ১৫টি দেশ ‘কাঁটা ঘাঁয়ে নুন ছিটালো’।

যে জাতি একটি সুষ্ঠূ নির্বাচন করতে অক্ষম, তাঁদের কটু কথা শুনতে হবে বৈকি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি, কোন দলই কিন্তু জোর করে বলতে পারছে না যে, তাদের আমলে অবাধ ও সুষ্ঠূ নির্বাচন হয়? অতীত সেকথা বলেনা। ক্ষমতা হস্তান্তরের একমাত্র বৈধ পথ ‘সুষ্ঠূ, অবাধ’ নির্বাচন। বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে মরিয়া, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্যে মরিয়া। সুতরাং-।

বিএনপি’র সমাবেশ কোথায় হবে, এনিয়ে সরকার ও বিরোধী দল একটি ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি, এটি জাতির দুর্ভাগ্য। এনিয়ে অযথা বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য বাড়ছেই। তাই হয়তো, বিএনপি’র গণসমাবেশ ঘিরে উত্তেজনা, বড় ধরণের সংঘাত, ও সন্ত্রাসী হামলার আশংকায় বৃটেন এর নাগরিকদের বাংলাদেশে চলাচলে সতর্কতা জারী করেছে।

বিদেশ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, নুতন করে আর কোন নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে সরকার মনে করছে না। টিআইবি বলেছে, খাদের কিনারে ব্যাঙ্ক খাত। সরকার কাঠখড় পুড়িয়ে বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। আর শুধু একটি প্রতিষ্ঠান ব্যাঙ্ক থেকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে? কেউ কিন্তু ঐসব ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান বা বোর্ড নিয়ে কথা বলছেন না?

নূর হোসেন-দের জীবনের বিনিময়ে রাজনীতিকরা বারবার ক্ষমতায় গেছেন, এরপর সব ভুলে গেছেন। নূর হোসেনরা বারবার রাজনীতির ঘুটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছেন। আর কত, গণতন্ত্রের জন্যে, একটি সুষ্ঠূ নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্যে আর কত মায়ের বুক খালি হবে? দেশে ভয়াবহ সমস্যার অশনি সঙ্কেত শোনা যাচ্ছে। মানুষ আর কত ভুগবে? শুধু রাজনৈতিক নন, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, প্রশাসন সবাই কিন্তু এজন্যে দায়ী থাকবেন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।