সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার ৪৩নং দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে বিতর্কিত ও সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত প্রধান শিক্ষক সেলিম মিয়া পুনরায় ওই বিদ্যালয়ে যোগদান প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছে এলাকাবাসী। 

আজ শনিবার সকাল ১১টার দিকে বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মোস্তাক ও স্থানীয় ২নং ওয়ার্ড সদস্য মো. কামরুল হাসান এর নেতৃত্বে বিদ্যালয় মাঠে এ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি মো. মোহর উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত ও বিতর্কিত প্রধান শিক্ষক সেলিম মিয়ার পুনরায় ওই বিদ্যালয়ে যোগদান প্রক্রিয়া বাতিলের দাবিতে বক্তব্য রাখেন, বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের বর্তমান সভাপতি মো. মনিরুজ্জামান মোস্তাক, বিদ্যালয়ের পিটিআই কমিটির সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন, ২নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. রোমান মিয়া, আশিকুর রহমান অন্তর, অভিভাবক সদস্য মো. হাবিবুর রহমান ও নাহিদুল হাসান প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, বিতর্কিত সেলিম মাস্টার ২০০৭ সালের ১৮ এপ্রিল এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীকে বিদায় দিয়ে বিকেলে ৫ শ্রেণির এক ছাত্রীকে পুরাতন বই পালটিয়ে নতুন বই দেওয়ার কথা বলে বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনের দু’তলায় নিয়ে যৌন হয়রানি করে। এ ঘটনা বিদ্যালয়ের অপর এক শিক্ষার্থী দেখে ফেলায় বিষয়টি গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় নিন্দার ঝড় উঠে। বিষয়টি পরে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে আপোষ মিমাংসা হয়। সর্বশেষ গত ২০২০ সালের ৯ জুন সকালে উপজেলার পূর্ব আব্দুল্লাপুরস্থ তার নিজ বাড়িতে একটি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়ানোর সময় দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৫ম শ্রেণির এক ছাত্রী (১২)’কে কৌশলে একা কোচিং সেন্টারে রেখে জোরপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ ঘটনায় সাময়িক ভাবে বরখাস্ত হওয়ার প্রায় ২ বছর পর সেলিম মাস্টার মামলার বাদীর সাথে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করে পুনরায় এ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করতে চাচ্ছে। আর এ সংবাদ দড়িগাঁও এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে উক্ত বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবক ও এলাকাবাসী সম্মেলিতভাবে বিতর্কিত সেলিম মাস্টারকে দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান প্রক্রিয়া বাতিলের দাবি করে বলেন, সেলিম মাস্টার মামলা শেষ করে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে থাকলে সে অন্য যেকোন বিদ্যালয়ে গিয়ে যোগদান করুক, দড়িগাঁও বিদ্যালয়ে কেন?

বিতর্কিত এ মাস্টার যাতে এ বিদ্যালয়ে যোগদান করতে না পারে এর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করে বক্তারা আরো বলেন, লম্পট সেলিম মাস্টার এই বিদ্যালয়ে পুনরায় যোগদান করতে আসলে এলাকা উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। কেননা সে তার স্কুল ছাত্রীদের একের পর এক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটিয়ে এলাকার এক শ্রেণির দালালদের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ঘটনার মিমাংসা করতে পেরে প্রতিবার পার পেয়ে যাচ্ছে। সে এ বিদ্যালয়ে যোগদান করতে পারলে আবারো কোমলমতি ছাত্রীরা তার যৌন লালসার শিকার হতে পারে এমন আশংকা থাকায় তাকে এ বিদ্যালয়ে যোগদান করতে দেওয়া হবেনা। আমরা এর প্রতিরোধ গড়ে তুলবো ইনশাআল্লাহ।

এলাকাবাসী জানান, এর আগেও ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে একাধিক যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে এবং প্রতিবারই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে স্থানীয় প্রভাবশালী মাদব্বরদের ম্যানেজ করে এবং তাদের সহযোগিতায় সেসব যৌন নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে সে।

এ ব্যাপারে সেলিম মাস্টারের সাথে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার কর্তৃপক্ষ আমাকে যেখানে দেয় সেখানেই যেতে হবে। তবে দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদানের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।

সর্বশেষ তথ্য মোতাবেক জানা যায়, কোভিট-১৯ করোনা ভাইরাস সংক্রমণ আতংকে মানুষ যখন দিশেহারা। তখনই সরকারি নির্দেশে সারা দেশে স্কুল-কলেজে পাঠদানসহ প্রাইভেট কোচিং-এ পড়ানো সম্পূর্ণ নিষেধ ঘোষণা করা হলেও সরকারি নির্দেশ অমান্য করে প্রাইভেট পড়ানোর অযুহাতে উপজেলার দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সেলিম মিয়া (৪২) গত ২০২০ সালের ৯ জুন সকালে উপজেলার পূর্ব আব্দুল্লাপুরস্থ তার নিজ বাড়িতে একটি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়ানোর সময় দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৫ম শ্রেণির এক ছাত্রী (১২) কে কৌশলে একা কোচিং সেন্টারে রেখে জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে।

এ ঘটনায় গত ২০২০ সালের ১৬ জুন ১২.৫০ পিএম সময় অনলাইন নিউজ ভার্সন পূর্বকণ্ঠ ডটকম-এ “কুলিয়ারচরে ফের সেলিম মাস্টারের বিরুদ্ধে এক স্কুল ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ! বিচার দাবীতে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি দেখে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল হাই তালুকদার ওই দিন থানার এসআই মো. আতাউর রহমানকে ওই স্কুল ছাত্রীর বাড়িতে পাঠান। এসআই মো. আতাউর রহমান সেলিম মাস্টারের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বস্ত করে স্কুল ছাত্রীর বাবাকে থানায় এসে লিখিত অভিযোগ করতে বলেন। পরে স্কুল ছাত্রীর বাবা কুলিয়ারচর ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সদস্যদের সহযোগিতায় ওই দিন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ইয়াছির মিয়া ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবাইয়াৎ ফেরদৌসীর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। পরদিন ১৭ জুন বুধবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে স্কুল ছাত্রীর বাবা মো. আপেল মিয়াকে বাদী করে সেলিম মাস্টারকে প্রধান আসামি করে ৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত নামা ৫/৬ জনকে আসামি করে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনী- ২০০৩ এর ১০ তৎসহ ৫০৬ দ.বি. ধারায় কুলিয়ারচর থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলা নং-০৯। মামলায় মো. নিজাম উদ্দিন মেম্বার (৫০), মো. কামরুল হাসান (৪৫) ও এমাদ মিয়া (৩৫) কেও আসামি করেন।

বিষয়টি এলাকায় জানা-জানি হলে এলাকাবাসীর মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজসহ তোলপারের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে এলাকার যুব সমাজ লম্পট সেলিম মাস্টারের বিচার দাবীতে ওই সালের ১৫ জুন সোমবার রাত ৭টার দিকে স্থানীয় মুজরাই মোড় বাজার রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এর দু’দিনপর ১৭ জুন বুধবার সকাল ১০টার দিকে সেলিম মাস্টারের বিচারের দাবীতে দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এলাকাবাসী একটি মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। এছাড়া ওই সালের ২৬ জুন শুক্রবার সকালে উপজেলার সালুয়া ফাজিল মাদ্রাসার সামনে বেলাব-ডুমরাকান্দা রাস্তায় স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ফ্রেন্ডস ক্লাবের উদ্যোগে ঘন্টাব্যাপী এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এসব মানববন্ধনে বক্তারা পুলিশকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, রহস্যজনক কারণে বহুল আলোচিত আসামি সেলিম মাস্টারকে গ্রেফতার করছেনা পুলিশ। এ বক্তব্যসহ মানববন্ধনের সংবাদ দৈনিক পূর্বকণ্ঠ পত্রিকাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে পুলিশ প্রশাসনের টনক নড়ে। অবশেষে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কুলিয়ারচর থানার এস আই আবুল কালাম আজাদ ও এসআই মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম ২০২০ সালের ৩ জুলাই শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে নরসিংদী জেলার আমিরগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি ভাড়াটিয়া বাসা থেকে আত্মগোপনে থাকা অভিযুক্ত সেলিম মাস্টারকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করে। এরপর তিনি সাময়িক ভাবে বরখাস্ত হন।

(এস/এসপি/ডিসেম্বর ২৪, ২০২২)