মাজহারুল হক লিপু


প্রত্যেক সন্তানের কাছেই নিজের বাবাই সেরা বাবা। আমার কাছেও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে আমার বাবাকে অন্যরকম বাবা বলে সম্বোধন করছি বিশেষ কারণে। এক কথায় বলতে গেলে,  আমার বাবা শুধু আমার বাবাই ছিলেন না, তার হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, শুভাকাঙ্ক্ষী, ভক্ত তাকে পিতার আসনে বসিয়েছেন। সেজন্য হয়তো আমি নিজেই বাবার স্নেহ,আদর অনেকটাই কম পেয়েছি যা অন্য সন্তানেরা তাদের বাবার কাছে অনেক বেশি পেয়ে থাকেন। তবে এ নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ তো নেইই বরং গর্ব হয় আমার বাবাকে নিয়ে।

ছয় ভাই বোনের ভিতর সবার ছোট আমি। বাড়ির পাশেই ১ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলো আমাকে। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠতেই আমাকে নিয়ে আসা হলো শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ৩ নং প্রাইমারি স্কুলে। বাবা তখন খুব ব্যস্ত মানুষ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক- সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়ে এতই ব্যস্ত যে আমাদের ৬ ভাই বোনের জন্য সময়ের বরাদ্দ খুবই কম। তবে নতুন স্কুলে যাওয়ার দুদিন পরেই বুঝলাম, কেন আমাকে এখানে আনা হলো। স্কুলের মাঠের সাথেই বাবার অফিসের জানালা। অফিস বলতে বাবার স্কুল এজি একাডেমির প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়। অতএব স্কুলের মাঠে আমার চলাফেরার উপর সবসময় তার নজর। মাঝেমাঝে জানলা দিয়ে চলত শাসন। তবে সব কষ্ট ভুলে যেতাম, যখন এই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পদ্মপাতায় মোড়া সন্দেশ, কখনো জিলাপি কখনো বা সিঙারা দিতেন। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও বাবা নামের মানুষটি অন্যরকম বাবা।

প্রাইমারি পড়া শেষ হলে বাবাকে সবাই বললেন, আগের ছেলেগুলো তো আপনার স্কুলে পড়েছে, ছোটটাকে সরকারি স্কুলে পড়ান। বাবার একই উত্তর, প্রধান শিক্ষক হয়ে যদি আমার স্কুলে আমার ছেলে না পড়ে অন্য বাবারা কেন তাদের ছেলেকে পাঠাবেন আমার স্কুলে । ভর্তি হলাম বাবার স্কুলে। বাবা প্রধান শিক্ষক তাই একটু বিশেষ আনুকুল্য পাব এরকমই ভেবেছিলাম। প্রাইমারি স্কুলের মত সেই সন্দেশ আর সিঙারা বাবা আমাকে দেননি। বাবা যেন আমাকে চিনতেই পারতেন না। বাবা বাংলা সাহিত্য আর ইংরেজি র্যরপিড পড়াতেন। খুব অচেনা মনে হত বাবাকে। ক্লাশের পরীক্ষায় প্রথম হতে পারতাম খুব কম। দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়েছি বেশি। অবশ্য প্রথম না হওয়ায় কখনো বাবা আমাকে কোন প্রশ্ন করেননি। শুধু পরীক্ষা নয়,স্কুলের প্রতিযোগিতাগুলোতেও আমি প্রথম হতাম কম। আমাদের স্কুল ছিলো সব ধরণের প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থল। সব স্কুলের ছেলে মেয়েরা আমাদের স্কুলে আসত প্রতিযোগিতা করতে।অনেক ইভেন্টে বাবা বিচারক থাকতেন। তখন থেকেই বুঝে গেছি বাবা থাকলেই প্রথম হব এমন আসা নেই। সেই বাবাই রাতে বাসায় ফিরে আমাকে বুঝিয়ে বলতেন কেন আমি প্রথম হইনি। কোথায় আমার উত্তরণ দরকার।

বড় হয়েছি আর বুঝেছি বাবা কত ব্যস্ত মানুষ । নিজের স্কুল নিয়ে যতটা না চিন্তা তার চেয়ে বেশি চিন্তা শিক্ষার বিস্তার নিয়ে। এজি একাডেমিতেই দেখেছি একটার পর একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জন্ম নিচ্ছে স্কুলের গর্ভে। তিন নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়, আদর্শ কলেজ, মহিলা কলেজ, দুধ মল্লিক বালিকা বিদ্যালয়, আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ নিয়ে সব সময় চিন্তিত তিনি। উল্লেখিত সবগুলো প্রতিষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক।মাগুরায় স্কাউটিংয়ের পথিকৃৎ তিনি।

অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন বাবা। সাথে ৪৪ বছর ধরে সৈয়দ আতর আলী পাবলিক লাইব্রেরি সাধারণ সম্পাদক। টাউন হল ক্লাবের ২২ বছরের সম্পাদক। শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যস্ততার কারণে সংসারে সময় দিতে পারতেন খুবই কম। তবু তার মধ্যেই সংসারের দায়িত্বে ছিলেন সচেতন। সবসময় সংসারের সব খবরই নিতেন বিভিন্ন মাধ্যমে।

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই বাবা তখন শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়েছেন। ভাবলাম এবার বুঝি ব্যস্ততা কমলো। কিন্তু ছুটিতে এসে দেখতাম সেই একই গতিতে ছুটছেন বাবা। তবে সকালে উঠেই স্কুলে যাওয়ার তাড়াটা আর নেই। সকালটা তখন কাটাতেন গান শুনে, বই পড়ে আর বাজার গিয়ে। এ এক নতুন কাজ। প্রায় প্রতিদিন বাজারে যাওয়া, প্রিয় মাছ তরকারি কেনা তাঁর নতুন অভ্যাসে পরিণত হলো। এমনকি মৃত্যুর দু একদিন আগেও তিনি বাজারে গিয়েছেন। অনেকেই আমাদেরকে বলেছেন, স্যারকে এ বয়সে একা ছাড়ো কেন? আমরা জানতাম, বাবা একাই যেতে চান। জানতাম, তিনি নিজেকে স্বনির্ভর ভেবে ভালো থাকেন।

বয়স আশির পর থেকে বাবার ব্যস্ততা একটু যেন কমলো। আমার সাথেও যেন বন্ধুর মত হয়ে গেলেন। শিল্প সংস্কৃতি সাহিত্য নিয়ে আলোচনা চলত নিয়মিত। আমি বাবাকে নিয়ে ঘুরতে গেলাম শান্তি নিকেতন, কোলকাতা, দিল্লী। কত গল্প বাসে, ট্রেনে, হোটেলে শুয়ে। এসময় বাবার কাছে জেনেছি তাঁর জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সম্পর্কে।

ব্যক্তিগত জীবনে বাবা ছিলেন মুক্তমনা প্রগতিশীল এক মানুষ। ছাত্রজীবনে রাজনীতি করেছেন। যশোর এমএম কলেজে ভিপি থাকা অবস্থায় যুক্ত হয়েছেন ভাষা আন্দোলনে। সরকারি চাকরিতে দুই দুইবার যোগ দিয়ে ছেড়ে চলে এসেছেন মাগুরায়। পিতৃভূমি ছাড়বেন না তাই সারাজীবন বেসরকারি শিক্ষকের চাকরি করেছেন। বাবার অনেক ছাত্রের কাছে শুনেছি, পকেট থেকে টাকা দিয়ে তিনি অনেক অস্বচ্ছল ছাত্রের ফরম ফিল আপ করে দিয়েছেন। নিজের বাড়ির প্রতি নজর দেননি কখনো। টিনশেডের বাড়িতে কাটিয়ে দিলেন প্রায় সারাটা জীবন।

দিল্লীর হোটেলে রাতে বিছানায় শুয়ে গল্প চলছিলো। বাবাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি কেন সরকারি চাকরি করলেন না? বাবা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, সরকারি চাকরি করলে কখন কোথায় থাকতাম ঠিক নেই। তখন তো মাগুরায় থাকা হত না। এত মানুষের ভালোবাসা পেতাম না। সারাজীবন তোদেরকে খুব সময় দিতে পারিনি। কিন্তু দেখ কত হাজার হাজার ছেলে মেয়ে মানুষ হয়েছে আমার হাতে। এরা সবাই আমার সন্তান। আর আমার সন্তানেরা ছড়িয়ে গেছে পৃথিবী জুড়ে। কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম, মানুষটার ভিতর কোন অপ্রাপ্তির ব্যাথা নেই। কি অদ্ভুত গর্ব তার।
তারপর থেকে ভাবি, এইতো আমার অন্য রকম বাবা।

লেখক : সহকারি অধ্যাপক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক