চৌধুরী আবদুল হান্নান


দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে উপরিউক্ত শিরোনামে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদের বিশ্লেষণমূলক ও পরামর্শমূলক চমৎকার একটি লেখা গত ২১ জানুয়ারী সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখায় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণহীনতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় ও দোষ দুটিই রয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে, ঋণ খেলাপিরা যত প্রভাবশালী হন, তাঁরা কিন্ত সরকারের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী নন।

অতীতে কাউকে শক্ত করে ধরেনি বলে তারা প্রভাবশালী হয়ে গেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ঋণ খেলাপিদের শক্ত বার্তা দিতে হবে। কিন্ত কীভাবে ঋণ খেলাপিদের বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের শক্ত বার্তা দেওয়া যায় ?

ব্যাংক ও আর্থিক খাত ভালো নেই, অনেকটা দুষ্টচক্রের কবলে নিপতিত। বিশেষ করে খেলাপি ঋণেরচাপ সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, হাবুডুবু খাচ্ছে ব্যাংকগুলো।

ব্যাংক খাতে কত টাকা খেলাপি ঋণ রয়েছে তার কোনো সঠিক তথ্য কোথাও পাওয়া যাবে না, এমন কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও প্রকৃত তথ্য নেই। কারণ ব্যাংকগুলোই সঠিক তথ্য দিতে চায় না, খেলাপি ঋণ গোপন রাখার চেষ্টা করে। খাতা কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখিয়ে ব্যাংকের স্বাস্থ্য আপাতত ভালো দেখানোর প্রবণতা রয়েছে ব্যাংকগুলোর ।এমন কি অবলোপনকৃত ঋণকেও খেলাপি দেখানো হয় না।

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আড়াল করে রাখা হয়েছে — এমন মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও। সংস্থাটির মতে এখানে খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, প্রকৃত খেলাপি ঋণ তার দুই বা তিনগুণ।

খেলাপি ঋণের পরিমান যা ই হোক না কেন, ব্যাংক খাতের বিপুল পরিমান খেলাপি ঋণ দেশের আর্থিক খাতকে দুর্বল করে ফেলেছে।

অর্থনীতিবিদ এবং আর্থিক খাত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতির প্রধান খল নায়ক আর্থিক খাতের দুর্বলতা এবং সবচেয়ে বড় সংকট ব্যাংক লুট।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আরও একটি তথ্য দিয়েছে — প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা যা পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের দ্বিগুণেরও বেশি। আমাদের বিশ্বাস করা অযৌক্তিক হবেনা যে, এই পাচারকৃত টাকার মধ্যে ব্যাংক থেকে কৌশলে বের করে নেওয়া টাকার পরিমান কম নয়। তারা সমাজের এমন এক শ্রেনীর লোক যারা ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নেন কিন্ত ফেরত দেন না, ব্যাংক লুটের টাকায় বিলাসী জীবন যাপন করেন আর বিদেশে টাকা পাচার করেন, নিরাপদ আশ্রয় গড়ার জন্য।

আপিল বিভাগের একটি মামলার শুনানিকালে প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন — কিছু লোক লেখাপড়া করে জনগণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য, অনেকেই ব্যাংক করেন জনগণের টাকা লুট করার জন্য, তারা হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যত নিয়ন্ত্রণহীনতা আর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যাংকগুলে আজ এক ধরনের ডাকাতের অভয়ারণে পরিনত হয়েছে। এখনই ঋণখেলাপিদের নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ না নিলে ব্যাংকগুলো এক সময় তাদেরই পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।

ঋণখেলাপিদের শক্ত বার্তা দিতে পরীক্ষামূলকভাবে এখনই যা করা যায় :

১। ব্যাংকের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া গাড়ীর সাইসেন্স নবায়ন না করতে বিআরটিএ কে অনুরোধ করা ।

২। পাশপোর্ট নবায়নের ক্ষেত্রে পাশপোর্ট অফিসকে একইভাবে জানিয়ে দেওয়া ।

৩। কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ না করা ।

৪। বিদেশ ভ্রমন নিয়ন্ত্রণ করা এবং অনুরূপ আর যা যা করা যায় ।

এ সকল উদ্যোগকে শক্ত বা কঠিন বার্তা বলা যায় না, তবে অনেক সময় বাঁধন বেশি শক্ত হলে তা সহজে ছিড়ে যায়। ইতিপূর্বে হয়েছেও তাই। সর্বোপরি, এ বিষয়ে ব্যাংকারদের সদিচ্ছা থাকতে হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।