শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : দিনাজপুরে কাজে আসছে না প্রাথমিক শিক্ষকদের ডিজিটাল হাজিরা মেশিন। সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বায়োমেট্রিক হাজিরা সিস্টেম (ডিজিটাল হাজিরা মেশিন) চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরই ধারাবাহিকতায় দিনাজপুরের ১৩ উপজেলায় মধ্যে ৬ টি উপজেলার ৮৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেনা হয়। তবে মেশিন কেনার চার বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ স্কুলে চালুই হয়নি কার্যক্রম। এরইমধ্যে বেশকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। এতে মেশিনটি যে উদ্দেশে কেনা হয়েছে তা পূরণ হচ্ছে না। নষ্ট হতে চলেছে  ৩'কোটি টাকার সরঞ্জাম।

দিনাজপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো.হোসেন আলী জানান,১৩টি উপজেলায় এক হাজার ৮৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৬টি উপজেলার ৮৬৯ টি বিদ্যালয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্লিপের ফান্ড থেকে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেনা হয়। যার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল প্রতিটি ২২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। কেনা মেশিনগুলোর মধ্যে সচল রয়েছে ৫৬৭টি এবং অচল ২০২টি।বাকি ৭টি উপজেলার এক হাজার বিদ্যালয়ে মেশিনটি কেনা হয়নি।

যেসব স্কুলে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেনা হয়েছে তার মধ্যে কোথাও স্থাপন করা হয়েছে আবার কোথায় বাক্সবন্দি করে রাখা হয়েছে। আবার কোথাও উদ্বোধনের অপেক্ষায় আজও চালুই করা হয়নি। মেশিন কেনার পর দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ থাকায় অধিকাংশ অচল হয়ে পড়েছে। মেশিনটি কেনার পর প্রায় এক বছর শিক্ষকরা নিজেদের মতো করে হাজিরা দিলেও করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ হয়ে যায়। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে মেশিনটি বাক্সবন্দি করে রাখা হয়েছে।

মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সরজমিনে বেলা ১১ টায় খানসামা উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলতে চাইলে সহকারি শিক্ষক জানান, স্যার অফিসের কাজে উপজেলায় আছেন। আমরা আছি, ক্লাস নিতে কোন সমস্যা হয় না। স্যারদের তো অধিকাংশ সময় অফিসের কাজে উপজেলায় থাকতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাহাঙ্গীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান’ই না, প্রতিনিয়ত শিক্ষা অফিসের নাম ভাঙ্গিয়ে ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছেন শিক্ষক নেতা ও অধিকাংশ স্কুল প্রধানরা।

শিক্ষকরা যেন ক্লাস ফাঁকি দিতে না পারে এ সমস্যা সমাধানের লক্ষে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলায় ১৪৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে বায়োমেট্রিক হাজিরাযন্ত্র। তবে এতেও কোন কাজ হয়নি, সফটওয়্যারের অজুহাত দেখিয়ে ৩ বছরেও চালু করা হয়নি সেই ১৪৩ টি বায়োমেট্রিক হাজিরাযন্ত্র। বরং উল্টো অভিযোগ উঠেছে সেই মেশিন ক্রয়ে অনিয়ম হওয়ার। প্রতিটি বিদ্যালয়ের স্লিপের ফান্ড থেকে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেনার জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২২-৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিলো। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বাজার যাচাই করে মেশিন ক্রয়ের কথা থাকলেও অফিসের নির্দেশনায় একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে মেশিন ক্রয় করেছেন সবাই। এসব মেশিনের বাজার দর জানা নেই শিক্ষকদের। তারা ভয়ে নামও বলছেন না সেই প্রতিষ্ঠানের। ২৫-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে যে ‘iclock9000-G’ মডেলের ডিজিটাল হাজিরা মেশিনটি বিদ্যালয়ে গিয়ে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তার সঠিক বাজারমূল্য আনুষঙ্গিক খরচসহ সাড়ে ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। প্রতিটি মেশিন ক্রয়ে ১৯ থেকে ২০ হাজার টাকা অনিয়ম করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে উপজেলা শিক্ষা অফিসের বিরুদ্ধে।

একাধিক সহকারি শিক্ষকরা বলছেন, মেশিন কবেই চালু হয়ে যেতো আমাদের শিক্ষক নেতারাই চায় না, এটি চালু হউক। কারণ প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষা অফিসের নাম ভাঙ্গিয়ে উপজেলায় রাজনৈতিক লিডারদের সাথে সময় কাটান শিক্ষক নেতারা। মেশিন চালু হইলে তো আর তারা এটা পারবে না।

মাদারপীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হানিফসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক নেতাদের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তারা জানান, আমাদের অফিসের কাজেই উপজেলায় যাওয়া হয়। এটা আমাদের শিক্ষা অফিসার ও সহকারি শিক্ষা অফিসার সবাই জানে। আর হাজিরা মেশিন মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে বন্ধ রয়েছে এখানে আমাদের প্রতিবাদের কিছু নেই।

উত্তর গোবিন্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফারজানা আক্তার বলেন, মেশিন আমরা যাচাই-বাছাই করেই ক্রয় করেছি। ২ বছরের সার্ভিস ও প্রশিক্ষণ দেয়াসহ মেশিন ক্রয় করাতে দামটা বেশি পরেছে। করোনার কারণে মেশিন চালু করতে পারিনি আবার সার্ভিসের মেয়াদও চলে গেছে। তাই এ নিয়ে কিছু বলতে পারছি না।

খানসামা উপজেলা শিক্ষা অফিসার এরশাদুল হক চৌধুরী বলেন, মেশিন ক্রয়ের বিষয়টি আমার জানা নেই, তবে শুনেছি স্লিপের টাকা থেকে প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ে হাজিরা মেশিন স্থাপন করেছে। মেশিনগুলো এখনো কেন চালু করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে কোম্পানী থেকে এগুলো ক্রয় করা হয়েছে তারা মেশিনের সফটওয়্যার দেয়ার কথা থাকলেও তা এখনো দেয়নি। তবে আমি যতটুকু জানি সিম কার্ডের মাধ্যমে এসব মেশিন থেকে শিক্ষকদের হাজিরা প্রিন্ট করা সম্ভব। এটিও তারা কেন করছেনা তা আমার জানা নেই।

এ ডিজিটাল হাজিরা মেশিনের সঙ্গে ইন্টারনেট বা ডাটা সংযোগ থাকবে। ফলে অফিসে বসে উপজেলা বা জেলার কর্মকর্তারা শিক্ষকদের নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া যেকোনো সময় পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। কিন্তু যে উদ্দেশে মেশিন কেনা হয়েছিল চালু না হওয়ায় তা ব্যাহত হচ্ছে।

দিনাজপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো.হোসেন আলী বলেন,আমি এ জেলায় যোগদানের আগে মেশিনগুলো কেনা হয়েছে। অনেক মেশিন চালু করা হয়নি। আরো এক হাজার দুইশত মেশিন কেনার কথা রয়েছে।
নতুন করে বরাদ্দ এলে পুরাতন সহ নতুন মেশিনগুলো চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি দিনাজপুর জেলা শাখার এক নেতা বলেন, প্রাথমিক শিক্ষাকে বেগবান করতে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন চালু করা হয়েছিল। কোম্পানির সঙ্গে দুই বছরের চুক্তি ছিল। করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে হাতেগোনা কিছু চালু আছে। তবে চালু মেশিনগুলো কারও ফিঙ্গার নিচ্ছে আবার কারও নিচ্ছে না, এমন অবস্থা হয়ে আছে। যন্ত্রটাও অনেকটা অকেজো হয়ে গেছে। আগামীতে কোনো নির্দেশনা পেলে ফের চালু করা হবে।

(এসএএস/এএস/ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩)