অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহে দিন দিন বেড়েই চলেছে মহাজনি সুদের কারবার। তাদের ফাঁদে পড়ে নি:স্ব হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সুদে কারবারির অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে বাড়ি ছাড়া হয়েছেন অনেকে। ঘটেছে একাধিক আত্মহত্যার ঘটনাও। সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে জেলাজুড়ে এই সুদের কারবারিদর বিরুদ্ধ শুরু করা হয়েছে অভিযান। এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ১০ জনকে। এ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে তাদের মাঝে। গ্রেফতার এড়াত গা ঢাকা দিয়েছেন অনেক মহাজন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলার ছয় উপজেলায় কয়েক হাজার সুদ কারবারি রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এসব মহাজনি কারবারিরা গ্রামের সহজ সরল মানুষকে টাকা ধার দেওয়ার নামে চড়া সুদের কারবার করছে। মেয়ে বিয়ে, ব্যবসা, পারিবারিক দৈন্যতাসহ নানা কারণে টাকা ধার নেন গ্রামের সহজ সরল হতদরিদ্র মানুষেরা। টাকা নেওয়ার সময় কৌশলে এসব মানুষের কাছ থেকে চেকের ফাঁকা পাতা নিয়ে নেন ওই সুদ কারবারিরা। মাসে প্রতি লাখে ১০ শতাংশ হারে সুদ নেওয়া হয় এসব ধারের টাকায়। কােথাও কােথাও এই সুদের হার ১৫-২০ শতাংশ বলে জানা গেছে। সুদের টাকা দিতে দেরি হলে কষা হয় চক্রবৃদ্ধির হার। ফলে জমিজমা বিক্রি করে মহাজনের টাকা পরিশাধ করত সহায় সম্বলহীন হয়ে পড়েন অনেকে।

অমিত বিশ্বাস নামে এক স্কুল শিক্ষক জানান, করােনাকালে অনটনে পড়ে তিনি এক সুদে কারবারির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন। এ সময় তাঁর কাছ থেকে ওই সুদে মহাজন একটি ফাঁকা চেক নিয়েছিলেন। দুই বছর তাকে ২ লাখ টাকা পরিশােধের পরেও অতিরিক্ত আরও ৪ লাখ টাকা দাবি করা হয় তার কাছে। দিতে না পারায় চেকের পাতায় ৬ লাখ টাকার অঙ্ক বসিয়ে আদালতে মামলা করা হয়। পরে বসতবাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা পরিশােধ করে তিনি এখন নি:স্ব হয়ে গেছেন।

সাগর (ছদ্মনাম) নামে এক সরকারি চাকরিজীবি জানান, স্ত্রী ও সন্তানের অসুস্থতা এবং অভাব অনটনের কারনে এক সুদ কারবারির কাছ থেকে তিনি ৬০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। তখন তাঁর কাছ থেকে কৌশলে তিনটি ফাঁকা চেকের পাতা নেন ওই কারবারি। কয়েকদফায় প্রায় দুই লাখ টাকা দেওয়ার পরও আদালতে তাঁর নামে ৬ লাখ টাকার মামলা দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সুদের রমরমা বাণিজ্য চলছে। এসব সুদ কারবারিরা এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না ভুক্তভােগীরা। জেলাজুড়ে এদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। গত কয়ক বছর টাকা পরিশাধ করতে না পেরে সুদি মহাজনের অত্যাচারে শুধু শৈলকূপা উপজেলায় নয়জনের আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বীর মুক্তিযােদ্ধাও রয়েছেন। তবে এসব সুদের কারবারির বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযানে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষের মাঝে। তাঁদের দাবি, পুলিশের এই অভিযান অব্যাহত থাকলে মানুষ এদের হাত থেকে রেহায় পাবে। সমাজে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।

ঝিনাইদহের সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযােদ্ধা লিয়াকত হােসন জানান, পুরাে জেলায় এদের দৌরাত্ম বাড়ছে। এদের মধ্যে ব্যক্তি পর্যায় ছাড়াও কিছু এনজিও রয়েছে। তারা সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পান না। এদের বিরুদ্ধে পুলিশের চলমান অভিযান অব্যাহত রাখার দাবিও জানান তিনি।

এ বিষয়ে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশিকুর রহমান বিপিএম পিপিএম (বার) জানান, এ জনপদে সুদ কারবারিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের অত্যাচারে অনেকে সহায় সম্বল ছেড়ে নিজ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে আবার অনেক আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। আমরা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সুদ কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছি। এ পর্যন্ত ১০ জন সুদকারবারীকে আটক করে দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়ের করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।

(একে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩)