ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সপ্তাহ না পেরোতেই ফের একটি তুলার গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শনিবার ১১ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের ছোট কুমিরা বাইপাস রোড সংলগ্ন হিঙ্গিরি পাড়া এলাকায় এস এল গ্রুপের মালিকানাধীন তুলার গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে সীতাকুণ্ড এবং আগ্রাবাদ ফায়ার স্টেশনের ৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকালে তুলার গোডাউনে মেরামতের কাজ করছিলেন শ্রমিকরা। গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে কাটিং কাজ করার সময় হঠাৎ আগুনের স্ফুলিঙ্গ তুলার উপর গিয়ে পড়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুনের ভয়াবহ দাবানল পুরো তুলার গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে।

সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ক্ষত এখনো মোছেনি। এর মধ্যে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে আবারও বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ৭ জন। আগের ঘটনায় অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ দিলেও সীতাকুণ্ড অঞ্চলের কল-কারখানা, জাহাজভাঙা ইয়ার্ড, রাসায়নিক মজুতের ডিপো, রি-রোলিং মিল, সিমেন্ট কারখানাগুলোতে শ্রমিকের নিরাপত্তায় কি আয়োজন আছে, সেটার পরিদর্শন করারও প্রয়োজন বোধ করেনি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো।

কেবল শ্রমিকের মৃত্যু হলে পরিবেশ অধিদপ্তর, কল-কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্তাদের ঘটনাস্থলে দেখা যায়। শনিবারের ঘটনায় আবারও আশ্বাস আর দায়ীদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি আসবে। ভেতরে ভেতরে চলবে দর কষাকষি। রক্তের দাগ শুকানোর আগে এসব সরকারি কর্তারা আরও একবার শীতনিদ্রায় চলে যাবেন। অপেক্ষা করবেন পরবর্তী কোনো দুর্ঘটনার।

এ দেশে সাধারণ মানুষের জন্য চারপাশে নানা ধরনের মৃত্যুফাঁদ। শ্রমিকের জন্য এ ফাঁদটা আরও গভীর ও বিস্তৃত। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠান মালিকের আইনি বাধ্যবাধকতা আছে। আর মালিক সেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে কি না, তা দেখভালের দায়িত্ব কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের। বিস্ফোরক দ্রব্যের ক্ষেত্রে সেই তদারকিতে যুক্ত হওয়ার কথা বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের।

বাস্তবে নিরাপত্তা দেখাশোনা করার সংস্থা যত বেড়েছে, শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতাও পাল্লা দিয়ে ততই বেড়েছে। তদারকি সংস্থাগুলোর গাফিলতিতে সীতাকুণ্ড অঞ্চলে সব সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন সাধারণ মানুষ।

ভৌগোলিকভাবে সমুদ্র সংলগ্ন অঞ্চল, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ও চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় সীতাকুণ্ডে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। কিন্তু এসব কারখানার বড় একটি অংশই শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেসব কারখানা শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত, তার অধিকাংশেরই হদিস পাওয়া যাবে এ সীতাকুণ্ডে।

রাসায়নিকের কারখানা, জাহাজভাঙা শিল্প ও রি-রোলিং মিল কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য কুখ্যাত। এখন সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে কনটেইনার ডিপো ও গ্যাস সিলিন্ডার প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট। এসব কারখানা পরিবেশ আইনে লাল-ক্যাটাগরির শিল্পপ্রতিষ্ঠান। তার মানে এগুলোতে উচ্চঝুঁকি আছে। এ ঝুঁকি মোকাবিলায় পরিবেশ ও শ্রম আইনে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা থাকলেও সেগুলো মানার বা মানানোর কারও কোনো গরজ নেই।

পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তারা যারা সীতাকুণ্ড অঞ্চলের এসব শিল্প-কারখানা তদারকির দায়িত্বে থাকেন, তাদের জন্য শ্রমিকের মৃত্যু অনেকটা আশীর্বাদের মতো। প্রতিটি মৃত্যু প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে তাদের দর কষাকষির সুযোগ তৈরি করে দেয়।

কমপক্ষে ৫০ জন শ্রমিক থাকলে যেকোনো কারখানা বা প্ল্যান্টে সেফটি কমিটি থাকার কথা। সেফটি নিয়মিত জরুরি নির্গমন মহড়া দেওয়া, বিপৎকালীন নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করা, নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে এমন কী কী উৎস আছে সেগুলো তদারকি করার কথা। সেফটি কমিটি ঠিকমতো কাজ করতে পারছে কি না, সেটা তদারকির দায়িত্ব কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের। অথচ সরকারি কর্মকর্তা ও শিল্পমালিক যোগসাজশে শ্রমিকের জন্য মৃত্যুর জমিন তৈরি হয়েছে। সীতাকুণ্ড আজ সেই জমিনের সমার্থক হয়ে উঠেছে।

শুধু মার্চ মাসের চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিস্ফোরণের ইতিহাস: সীতাকুণ্ড বিস্ফোরণ, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ড, এরমধ্যে রাজধানীর সায়েন্সল্যাবেও বিস্ফোরণ।ঢাকার সাইন্সল্যাব এলাকায় একটি তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনে ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি অক্সিজেন কারখানায় বড় বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন হতাহতের ঘটনা ঘটছে।এর মধ্যেই আবার শনিবার (১১ মার্চ) উপজেলার ছোট কুমিরা ন্যামসন কন্টেইনার ডিপোর পাশে এ ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি তুলার গোডাউনে আগুন লেগেছে। খবর পেয়ে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের দুটি স্টেশনের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।তাৎক্ষণিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে জানা যায়নি।
এর আগে, গত ৪ মার্চ সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ৭ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া শরীরে পোড়া ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন হাজারো মানুষ। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর গুলিস্তানের কাছে সিদ্দিকবাজারের নর্থ-সাউথ রোডে ১৮০/১ হোল্ডিংয়ের সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এখন প্রশ্ন- এ ধরণের দুর্ঘটনার দায় কার?

এই তিন ঘটনার বাইরেও বিগত কয়েক বছরে বড় ধরণের বিস্ফোরণের খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। তবে সবকটি বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে ‍‍`জমে থাকা গ্যাসের‍‍` বিষয়টিকে দায়ী করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্তে কর্তৃপক্ষের অবহেলা প্রকাশ্যে এলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। বেশিরভাগ সময় দায় চাপিয়ে দেয়া হয় ভবন মালিকের উপর।

ফায়ার সার্ভিসের দাবি, জনগণের অসচেতনতার কারণেই বার বার এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনার আগে এর প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কয়েকটির দুর্ঘটনার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। যে কটির তদন্ত প্রতিবেদন সামনে এসেছে সেখানে বিস্ফোরণের পেছনে মূলত দায়ী করা হয়েছে ভবন বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে।

এভাবে গ্যাস থেকে একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব ঘটনায় মারা যাচ্ছেন অনেকে। এর দায় কার? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে এর দায়ভার নিতে চায় না কেউই। প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টদের দায় এড়ানোর চেষ্টার মধ্যেই একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা।

যত দোষ

প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনার পর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রতিবারই একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রিপোর্ট দেয়ার জন্য কমিটিগুলোকে সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন আসতেই লম্বা সময় পেরিয়ে যায়। আবার প্রতিবেদনে তদন্তের ফলাফল সামনে এলেও দুর্ঘটনার সকল দায় শেষ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি, ভবন মালিক, কারাখানা মালিক বা মসজিদ কর্তৃপক্ষের ওপরেই চাপানো হয়।

"মানুষ ভীষণ অসচেতন, তারা ব্যস্ততার অযুহাত দিয়ে গ্যাসের লিকেজ ঠিক করে না, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার বদলাতে চায় না। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখে না। এভাবে আমরা ঝুঁকি তৈরি করছি। কিন্তু এতো ঘটনার পরও কারও টনক নড়ে না।" এমনটাই জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক তাজুল ইসলাম চৌধুরী।

পরিশেষে বলতে চাই, কেন বার বার ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে? কারণ, কোনো কারখানা বা শিল্পমালিককে শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারের আওতায় আনা হয় না।

নির্মম সত্য হলো সংশোধিত শ্রম আইনে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যু হলে ২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মালিকের দায়মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।আবার যাদের গাফেলতির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাদের কারও বিরুদ্ধে তড়িৎ কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।

কিন্তু একটি ভবনের নকশা অগ্নি নিরাপত্তা মেনে করা হয়েছে কিনা, আগুন নেভানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে কিনা, সেইসাথে কেমিকেল মজুদ বা কারখানার লাইসেন্স দেয়ার সময় পর্যাপ্ত নজরদারি ছিল কি না সেগুলো নিয়মিত তদারকি করার নিয়ম সরকারি সংস্থাগুলোর।

আবার কোন ভবনে অবৈধ বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংযোগ কিভাবে এলো, এই অক্সিজেন কারাখানা নিয়ম মেনে পরিচালিত হচ্ছিল কিনা, কন্টেইনার ডিপোতে এতো ক্যামিকেলের মজুদ কিভাবে হল, সেটা নিয়ে কোন আলোচনা দেখা যায়নি। এসব বিষয় তদারকি করা সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলেও বার বার তাদেরকে দায় এড়াতে দেখা গিয়েছে।

দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার মধ্যে রয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরণ পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদফতর এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।এছাড়া ব্যাংক এবং ইনস্যুরেন্স কোম্পানিও দায়বদ্ধ থাকে। কিন্তু তদন্ত শেষে ভবন বা প্রকল্পের মালিক ছাড়া আর কাউকেই দায়ী করতে দেখা যায়নি। আবার গাফেলতির অভিযোগে দায়ী মালিককে শাস্তির আওতায় আনার নজিরও বিরল। আর আমাদের এখানে মনিটরিংয়ের জায়গায় বড় ঘাটতি রয়েছে। আবার এতো সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও রয়েছে। এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি থাকলে দায়িত্বে অবহেলার জায়গাগুলো আর থাকবে না।”

সেইসাথে সচেতনতার ওপরেও জোর দিতে হবে । প্রথমত গ্যাসের লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং যেখানে গ্যাস জমার আশঙ্কা রয়েছে যেমন রান্নাঘর বা টয়লেটে যেন বিশুদ্ধ বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকে। কোন আবদ্ধ জায়গায় গ্যাসের গন্ধ পেলে লাইন ফ্যান জালানোর আগে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করা।

আর “রানা প্লাজার ঘটনার পর যখন বিদেশের বায়াররা শর্ত জুড়ে দিল যে গার্মেন্টসের ফায়ার সেফটির না থাকলে তারা পোশাক কিনবে না। তখনই রাতারাতি এসব প্রতিষ্ঠানের চেহারা বদলে গিয়েছে। আমাদেরও সমন্বিতভাবে নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে এক হওয়া দরকার।আর সেইসঙ্গে রয়েছে আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা। এ রকমের দুর্ঘটনা ঘটলে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য আমাদের দক্ষ জনবল, পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও উন্নত প্রযুক্তির অভাবসহ রয়েছে নানা ঘাটতি।

আমাদের প্রত্যাশা, তদন্ত সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ নিতে হবে। ভবিষ্যতে এসব ঘটনা রোধ এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।