মোঃ আব্দুল কাইয়ুম, মৌলভীবাজার : এই সময়ের প্রকৃতিতে মৌলভীবাজারের দিগন্ত প্রসারিত বিশাল উপত্যকার ঘন সবুজ চা বাগানের অপরূপ নজরকাড়া সৌন্দর্য জানান দেয়ার কথা থাকলেও সময় মতো বৃষ্টি আর অনুকুল আবহাওয়া না থাকায় বেশিরভাগ চাবাগান গুলোতে চলছে এক প্রকার খরা। যথা সময়ে বৃষ্টি আর অনুকুল আবহাওয়া চা শিল্পের মূল নিয়ামক শক্তি। এর ব্যত্যয় হলে তাঁর প্রভাব উৎপাদনকে ব্যাহত করবে এটাই বাস্তবতা। বছরের তৃতীয় মাস অর্থাৎ মার্চের প্রথম থেকেই বৃষ্টি শুরু হওয়ার কথা, কিন্তু মাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও হয়নি আশানুরূপ বৃষ্টি। ফলে বৃষ্টি নির্ভর মৌলভীবাজারের চাবাগান গুলোতে চলছে এক প্রকার খরা। এমন পরিস্থিতিতে লক্ষ্য মাত্রা পূরণেও তৈরি হয়েছে শঙ্কা। জেলার চা বাগান গুলোতে‘প্রুনিং’ শেষে এখন গাছে গাছে কচি পাতা গজানোর কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। অনেক জায়গায় গাছ আছে, কিন্তু পাতা নেই।

গত শনিবার (১৮ মার্চ) সদর উপজেলার হামিদিয়া চাবাগান ও শ্রীমঙ্গল উপজেলার মাজডিহি চাবাগান,কমলগঞ্জের মিরতিঙ্গা চাবাগান ও শ্রীমঙ্গলের ফিনলের ভাড়াউরা চাবাগানসহ বেশ কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা যায় বিভিন্ন সেকশনের বেশ কিছু জায়গায় খরার কারণে কচি কুঁড়িগুলো জ্বলে যাচ্ছে। খরা আর বৃষ্টি না হওয়ায় কিছু কিছু বাগানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল চালিত পানির পাম্প দিয়ে ইরিগেশন (সেচ প্রকল্প) পদ্ধতিতে চা গাছ গুলোতে পানি ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই পাম্প চালাতে প্রতি ঘন্টায় খরচ হয় ৮ থেকে ১০ লিটার ডিজেল। চায়ের চাষাবাদের জন্য কৃত্তিম এ পদ্ধতিটি যেমন ব্যয় বহুল তেমনি এর দ্বারা সার্বিক চাষাবাদের জন্য যে পরিমাণ পানির চাহিদা রয়েছে তাও পুরণ করা সম্ভব হচ্ছেনা।

দেখা যায় ,শ্রীমঙ্গল উপজেলার ফিনলে কোম্পানীর ভাড়াউরা চাবাগানের একটি সেকশনে পাম্প দিয়ে পানি ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে চায়ের গাছে। মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি না আসলে উৎপাদন আর চাষাবাদ অব্যাহত রাখতে সাধারণত এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিশাল এই বাগানের মোট ২০ থেকে ২৫ শতাংশ জায়গায় পানি দেয়া সম্ভব হয়। প্রতি চারঘন্টা পরপর জায়গা পরিবর্তনের মাধ্যমে ছিটানো হয় পানি। তবে ডিজেলের বাড়তি খরচ আর বিশাল বাগানে পাম্প চালানো ব্যয়বহুল হওয়ায় সীমিত সংখ্যক বাগানেই এই পদ্ধতি চালু রয়েছে বলে জানিয়েছেন ফিনলে চাবাগানের ভাড়াউড়া ডিভিশনের জিএম শিবলী। মৌসুমের শুরুতে চায়ের উৎপাদনে প্রয়োজন ধারাবাহিক বৃষ্টি আর অনুকুল আবহাওয়া। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত আর লম্বা সময় খরা এ-দুটোই চায়ের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করছেন চা শিল্প সংশ্লিষ্টরা। চা উৎপাদনে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বৃষ্টি আর স্বাভাবিক তাপমাত্রা। তবে লম্বা সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকাটাও ক্ষতিকর। এতে পোঁকা-মাকড়ের আক্রমণের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

ফিনলে চাবাগানের ভাড়াউড়া ডিভিশনের জিএম শিবলী বলেন, মার্চের শুরু থেকে বৃষ্টি হয়নি,তবে সামনের মাসগুলোতে পর্যাপ্ত বৃষ্টি আর আবহাওয়া অনুকুলে না থাকলে এবছরও চায়ের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, দেশে চায়ের উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধির পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানীমূখী চা বিদেশে রপ্তানী করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। সেই লক্ষ্যে এবারও রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের আশা। মৌলভীবাজারেও চলতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ২ হাজার মিলিয়ন কেজি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২২ সালে একলাখ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হলেও ওই বছর উৎপাদন হয়েছে ৯৪ মিলিয়ন কেজি চা।

শ্রীমঙ্গলের জেরিন চাবাগানের ব্যবস্থাপক সেলিম রেজা চৌধুরী বলেন, এবছর লম্বা সময়ে খরা গেছে,পর্যাপ্ত বৃষ্টিও হয়নি। তবুও আমরা ইরিগেশন পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে গেছি। তিনি বলেন,সামনে পর্যাপ্ত বৃষ্টি আর অনুকুল আবহাওয়া থাকলে এবছর চা উৎপাদনে লক্ষমাত্রা পূরণ সম্ভব হবে।

এদিকে লম্বা সময়ে খরার কবলে থাকা জেলার চা বাগানগুলোতে রবিবার রাত থেকে হাল্কা বৃষ্টিপাত শুরু হলে দেখা দেয় কিছুটা স্বস্তি।

আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার শ্রীমঙ্গলের আবহাওয়া সহকারী মো. আনিসুর রহমান জানান, রবিবার সকাল ৬টা থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত শ্রীমঙ্গলে ১৯মিলিলিটার বৃষ্টি হয়েছে। মঙ্গলবারও বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরো জানান,সামনের সাপ্তাহে তাপমাত্রা আরো বাড়বে।

দেশের মোট ১৬৭ টি চাবাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে মোট ৯২টি চাবাগান। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে বেশি সংখ্যক চাবাগান।

উল্লেখ্য, চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি) শ্রীমঙ্গলে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট আয়োজিত ৫৭তম বিটিআরআই বার্ষিক কোর্স-২০২৩ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চা বোর্ডের (বিটিবি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছিলেন সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে এবং ২০২৩ সালে চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ১০০ মিলিয়ন কেজির বেশি ধরা হয়েছে। যা ২০২২ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০০ মিলিয়ন কেজি।

(একে/এসপি/মার্চ ২০, ২০২৩)