ওয়াজেদুর রহমান কনক, নীলফামারী : '২৫ মার্চ, জাতীয় গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির জীবনে এক বিভীষিকাময় রাত নেমে আসে। মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানানদার বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাপুরুষের মত তাদের পূর্ব পরিকল্পিত অপারেশন সার্চলাইটের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালিদের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু এক রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিলনা, এটা ছিল মূলত বিশ্ব সভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা মাত্র।

এদিন মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে উঠে বিভীষিকাময়।'

আজ নীলফামারী জেলা প্রশাসন আয়োজিত আলোচনাসভায় বক্তারা ২৫ মার্চের গণহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় এসব কথা বলেছেন। জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষ, পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ, সাবেক উপসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম আমিনুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার কান্তি ভূষণ কুন্ডু, জেলা স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মজিবুল হাসান চৌধুরী শাহিন, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিদ মাহমুদ।

বক্তারা আরও বলেন,'এদিন পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সকল পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান'

২৫ মার্চের রাতের ভয়াবহতা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং শেষ শত্রু বিদায় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান।

বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।

দিনটির স্মরণে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সকাল সাড়ে নয়টায় নীলফামারী সরকারী কলেজ বধ্যভূমিতে রাষ্ট্রের পক্ষে জেলা প্রশাসক পঙ্কজ ঘোষের পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে গণহত্যা দিবসে শহীদদের স্মরণ করা হয়। এরপর পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান গণহত্যার শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছেন। পুলিশ সুপারের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর পর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সাবেক সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম আমিনুল হক, সাবেক জেলা ডেপুটি কমান্ডার কান্তি ভূষণ কুন্ডু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে গণহত্যায় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করেন। এ উপলক্ষে আজ রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত ১ মিনিটের জন্য জরুরি স্থাপনা ও চলমান যানবাহন ব্যতীত সারাদেশে প্রতিকী ব্ল্যাকআউট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।

স্কুল, কলেজ এবং মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কন্ঠে ২৫ মার্চ গণহত্যার স্মৃতিচারণ ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।

এছাড়াও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোতে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে এবং সকল জেলা ও উপজেলায় ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই দিনটি জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

(ওআরকে/এএস/মার্চ ২৫, ২০২৩)