ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বাঙালি জাতির জীবনে অনন্য এক দিন আজ রবিবার ২৬শে মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২০২৩। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই স্বাধীনতা, এই দিনে জাতি স্মরণ করছে বীর শহিদদের৷ স্বাধীনতা দিবস তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়ার ইতিহাস৷পাকিস্তানের শোষণ-বঞ্চনার ‍অবসান ঘটিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেওয়ার ৫২ তম বার্ষিকীতে স্বাধীনতা দিবস ।প্রতিবছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করে দিবসটি উদ্যাপন করে গোটা জাতি। বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করে স্বাধীনতার জন্য আত্মদানকারী দেশের বীর সন্তানদের। শ্রদ্ধা জানায় মহান স্বাধীনতার রূপকার বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জাতীয় নেতা, নৃশংস গণহত্যার শিকার লাখো সাধারণ মানুষ এবং সম্ভ্রম হারানো মা-বোনের প্রতি। ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস তা প্রায় সবাই জানে। কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের কারণ বা এর পেছনের ইতিহাসটা কি? আমাদের মধ্যে অনেকেই সঠিকভাবে জানে না স্বাধীনতা দিবস কি। অথচ স্বাধীনতার এই সোনালী সূর্য ছিনিয়ে আনার জন্য জীবন দিয়েছেন লক্ষ লক্ষ শহীদ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস কবে?

২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের তাৎপর্যপূর্ণ এই দিনটিকে স্মরণ করে প্রতি বছর গভীর শ্রদ্ধা ও ভাবগম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করা হয় দিনটি।

স্বাধীনতা দিবসের ইতিহাস

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতের পশ্চিমে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব দিকের ভূখণ্ড তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) মধ্যে বৈরীতার হাওয়া দেখা যাচ্ছিলো শুরু থেকেই। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পশ্চিম পাকিস্তান ভাষাসহ চাকরি ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে বৈষম্যের আচরণ করতে থাকে- যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে একটা অনিবার্য সংঘাতের দিকে মোড় নেয় পরিস্থিতি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার গভীর রাতে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নিরীহ জনগণের উপর হামলা চালায় ও গ্রেপ্তার করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে গ্রেপ্তারের কিছু আগেই ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন।

জাতির জনকের ঘোষণাটি নিম্নরুপ: এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।

২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে শেখ মুজিব এর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি মাইকিং করে প্রচার করা হয়। পরে ২৭শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

স্বাধীনতা দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়; তবে সে সময় এই ভূখণ্ডের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। দীর্ঘদিনের ইংরেজ শশাষণ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতার সুবাতাস পাবে তা ছিল এই অঞ্চলের মানুষের একান্ত প্রত্যাশা, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও এ অঞ্চলের মানুষের শােষণমুক্তি ঘটেনি। স্বীয় রাষ্ট্রের অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। পাকিস্তানিদের প্রকৃত চেহারা উপলদ্ধি করে। মানুষের মনে ধীরে ধীরে দানা বেঁধে ওঠে স্বাধীনতার স্বপ্ন। অবশেষে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই, অর্থাৎ ২৬-এ।

মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭-এ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘােষণা। স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম একদিনে সংঘটিত হয়নি; বহুদিন ধরে ধীরে ধীরে এ সংগ্রাম মহিরুহ রূপ পেয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সােপান। ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষা আন্দোলনেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা প্রণয়ন ও তৎপরবর্তী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান প্রভৃতি ঘটনার মধ্যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন নিহিত ছিল।১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে এদেশের মানুষ ভােট দিয়েছিল। কিন্তু শাসকদের চক্রান্তে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেনি তারা। সেই প্ৰবনা ও পরবর্তীকালে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম গণহত্যাই বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনকে চরমতম রূপ দেয়।

স্বাধীনতা দিবসের তাৎপর্য: জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এই দিনটি প্রত্যেক বাংলাদেশীর জীবনে বয়ে আনে একই সঙ্গে আনন্দ-বেদনা-গৌরবের এক অম্ল-মধুর অনুভূতি। একদিকে হারানোর কষ্ট অন্যদিকে মুক্তির আনন্দ। তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছাড়িয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির অপার আনন্দই বড় হয়ে ওঠে প্রতিটি বাঙালির কাছে। গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি প্রতিবছর আসে আত্মত্যাগ, আত্মপরিচয় ও ঐক্যের বার্তা নিয়ে। সেই সাথে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য। নব উদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও দিকনির্দেশনা নিয়ে আসে এই দিন। আমাদের উচিত এই দিনটিকে শক্তিতে পরিণত করে নতুন দিনের পথে এগিয়ে চলার।

স্বাধীনতার স্বপ্ন

স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল একটি শােষণমুক্ত ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রাষ্ট্র প্রবর্তন করা। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সবাইকে স্বনির্ভর করেছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই লক্ষ্য নিয়েই দেশ গঠন শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন একনায়ক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। ১৯৯০-এ স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে দেশে পুনরায় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা সূচিত হয়। আশার কথা এই যে, বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হয়েছে।

স্বাধীনতা অর্জনের মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীনতা অর্জনে এদেশের মানুষ সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে এদেশের ত্রিশলাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, অত্যাচারিত হয়েছে— সম্ভ্রম হারিয়েছেন কয়েক লক্ষ মা-বােন। আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানিদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে। এদেশের সর্বস্তরের মানুষ যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, তখন দেশীয় এই রাজকারদের তৎপরতায় বহু মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে, সম্ভ্রম হারিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। বহু মুক্তিযােদ্ধাদের নিজেরা হত্যা করেছে, পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে এই রাজাকার বাহিনী। দেশের অভ্যন্তরে এই শত্রুদের বিনাশ করে স্বাধীনতা অর্জন করতেই একটি সামরিক পরিকল্পনা করে তৎকালীন (১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে গঠিত হয় অস্থায়ী সরকার) অস্থায়ী সরকার। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন কর্নেল
এমএজি ওসমানী। তাঁর নেতৃত্বে এবং বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের মিত্রবাহিনীর তৎপরতায় ও সহযােগিতায় ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর এদেশ স্বাধীন হয়।

পরিশেষে বলতে চাই , মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীনতার অধিকারপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশে ও বিশ্বে পরাধীনতাই যেন সবাইকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। আমাদের সমাজেও সুপ্তভাবে এই প্রক্রিয়াটি লক্ষ করা যায়। কিন্তু ভুললে চলবে না আমাদের স্বাধীনতা অনেক রক্তের দামে কেনা; শহিদদের এই পবিত্র রক্তের দায় জাতি হিসেবে আমাদের সবারই। সেই দায় শােধ হতে পারে কেবল স্বাধীনতাকে সবার জন্য ভােগ্য করে তােলার মাধ্যমে। এই প্রত্যয় নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যৎকালের পথে। স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য বেশি প্রয়োজন সংগ্রাম ও শক্তির। আর স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রযুক্তি, কৌশল, ঐক্য ও ন্যায়বোধ।

এ ছাড়া স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে জ্ঞান, বুদ্ধি, শিক্ষা ও সৎ বিবেচনাকে কাজে লাগানো একান্ত অপরিহার্য। মূলত যথেষ্ট সচেতন ও সংঘবদ্ধ না হলে স্বাধীনতাকে রক্ষা করা যায় না।স্বাধীনতা রক্ষার জন্য স্বাধীনতাকে মর্যাদা দিতে হয় এবং সদা সতর্ক থাকতে হয়। তাই স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করে একে রক্ষা করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য মনে করা উচিত। আর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে জীবনপণ সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম অর্জন- মহান স্বাধীনতা।স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণের এই মৌল চেতনা সবাইকে অনুপ্রাণিত করুক- এটাই মহান স্বাধীনতা দিবসে প্রত্যাশা।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।