চৌধুরী আবদুল হান্নান


মার্চ মাস আসে, যায়। বঙ্গবন্ধুর জন্ম মাসে তাঁর প্রতি বিপুল শ্রদ্ধা , ভালোবাসা নিবেদন করে বাঙালি জাতি। শুধু মার্চ কেন, সারা বছরই জাতির পিতার ভাবনা-দর্শন নিয়ে সভা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, নতুন প্রজন্ম জানতে পারে কীভাবে এই বিশাল হৃদয় মানুষটি ক্রমান্বয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। এক সময় তিনি সময়ের ডাক কাজে লাগালেন, তাঁর যাদুর বাঁশিটি বাজালেন, পুরো জাতি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লো। “ঢাল নেই, তলোয়ার নেই” নিরস্ত্র বাঙালি কী দিয়ে যুদ্ধ করবে ! যার যা আছে তাই নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আহবানে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ঝিমিয়ে পড়া, ঘুমিয়ে থাকা মানুষ বীরদর্পে জেগে উঠলো এবং অল্প সময়ে আক্রমণকারী বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পর্যদুস্ত করে দিল।

আমাদেরও “কপাল ভালো” ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায়, পার্লামেন্টে তাঁর কথাই শেষ কথা। সে কারণে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো ভিন্ন মতের তোয়াক্কা করতে হয়নি।

আমাদের এ যুদ্ধ যয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনন্য অবদানও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে। জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক শুধু একটি স্বাধীন ভূখন্ডের জন্য লড়াই করেননি, ক্ষুধা ওদারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন।

স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দির বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমরা কী দেখি? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণেরঅগ্রগতি দেখে আমাদের কেবল হতাশই হতে হয়। আমরা জাতি হিসেবে সৌভাগ্যবান, এ জন্য যে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং সে কারণে আমাদের প্রত্যাশাটা আরও বেশি।

প্রায় দুই দশক তিনি সরকার পরিচালনা করছেন, রাষ্ট্র ক্ষমতায় একটি সরকারের জন্য সময়টা কম দীর্ঘ নয়। সে বিবেচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তির অপূর্ণতা ব্যাপক এবং বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ব্যর্থাতা নজিরবিহীন। অর্থ লুটপাট ও পুঁজি পাচারের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থা বর্তমানে দুষ্টদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ছিল বহুমাত্রিক দর্শন কিন্ত ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা ছিল তাঁর জীবন দর্শনের অন্যতম দিক। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটি একটি মৌলিক শর্ত।

আওয়ামী লীগ ১৯৫৫ সালে ঘোর ধর্মান্ধতার যুগে প্রাকাশ্যে অসাম্প্রদায়িক আদর্শ গ্রহণ করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল কিন্ত আজও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয়নি।

ক্ষমতা বলয়ের চতুর্দিকে থাকে চাটুকার আর সুযোগ সন্ধানীরা। সে কারণে যুগে যুগে তিনিই ভালো শাসক হয়েছেন যিনি সকল পারিষদের পরামর্শ শ্রবণ করেন কিন্ত সিদ্ধান্তটা নিজেই নেন।

চাটুকারীতার জবাব একবার দিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত দেশের ত্রাণকর্তা মহামতি লেনিন। চাটুকারদের তৈলমর্দন শেষে লেনিন বলেছিলেন, “আমি নিজের রসে সিক্ত হতে প্রস্তুত নই!” পরিষদ বর্গের তোষামোদ আর চাটুকারিতার প্রতি এমন মোক্ষম জবাব পৃথিবীর আর কোনো নেতা দিয়েছেন কিনা আমার জানা নেই।

যোগ্য নেতা তোষামোদকারী ও স্বার্থান্বেষীদের চিনতে ভুল করেন না এবং দেশ প্রেমিক ও সৎ-যোগ্য লোকদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেন এবং সেটাই একটি দেশের সম্মৃদ্ধির অগ্রগতির পূর্বশর্ত। এটাই হবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার মূলমন্ত্র।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু গান্ধীজীর মৃত্যু সংবাদ বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেনএই বলে যে, “ আমাদের জীবনের আলো নিভে গেছে।” মাহাত্ম গান্ধী নেই কিন্ত তাঁর মানবতাবোধ, অহিংস নীতি এখনো আলো দিয়ে যাচ্ছে।

তেমনি বঙ্গবন্ধুর চেতনা, আদর্শ আমাদের বর্তমান এবং আগামীর দিক নির্দেশনা, এগিয়ে যাওয়ারপ্রেরণা যা কখনো নির্বাপিত হবে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।