রহিম আব্দুর রহিম


আমরা ইস্যু খুঁজি,কখন কাকে কিভাবে ধোলাই দিতে পারি। একইভাবে প্রশাসনের কিছু কর্মচারী রয়েছেন, তাঁরা মনে করেন আমরাই প্রভু, বাকীরা আমাদের চাকর। এই দু'য়ের ভাবনা ও মানসিকতা এক প্রকার অতিমাত্রায় 'সার' প্রয়োগের ফলে জ্বলে যাওয়া প্রোটিনহীন খাদ্যজাত দ্রব্যের মত। সম্প্রতি দু'টি ঘটনা সামাজিক যোগাযোগে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে। তার একটি বগুড়ার অতিরিক্ত ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইসায়মিন, অন্যটি রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন।

রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্ডিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুককে বাধ্য করেছেন তাঁকে (ডিসিকে) স্যার বলতে। অন্যটি বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এক শিক্ষার্থীর মাকে তাঁর (জজের) পা ধরতে বাধ্য করেছেন। এই বিচারক কেনো এমনটি করেছেন তা তিনিই ভাল জানেন, আমার বিশ্বাস জজ সাহেবের কোন আদর্শিক শিক্ষায় ত্রুটি রয়েছে।আর এই ভয়ংকর ত্রুটির জন্য দায়ী হয়তবা তাঁর পারিবারিক অথবা প্রাতিষ্ঠানি শিক্ষা, সার্বিক পরিবেশ কিংবা শিক্ষাকর্মীরা। এধরনের ঘটনার জন্য আদৌ এই বিচারককে দায়ী করা যাবে না। প্রায়শ ঘটে যাওয়ার মত ঘটনাটি (এবারের দ্বিতীয়) রংপুরে জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনিন, তিনি তাঁর অফিসে আসা এক সহযোগী অধ্যাপক, তাঁকে (ডিসিকে) 'স্যার' বলেনি বলে কষ্ট পেয়েছেন; এরপর তিনি তাঁকে (ডিসিকে) 'স্যার'বলতে বাধ্য করেছেন অধ্যাপককে। অধ্যাপক ছাড়ার পাত্র নয়, সে ডিসিকে 'স্যার' সম্বোধনে নিজে ছোট মনে করেছেন, আবারে তাঁকে 'স্যার' সম্বোধনে করাতে বাধ্য করায় তিনি প্রচন্ড অপমান হয়েছেন এটাই সত্য। অধ্যাপক এর প্রতিশোধ বা প্রতিরোধে ডিসির অফিসের সামনে অবস্থান করার বিষয়টি লুফে নিয়েছেন নেটিজনরা। শুরু হয়েছে আলোচনা, সমালোচনা, তোলপাড় সারাদেশব্যাপী।

এ বিষয়ে জাতীয় দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানের বরাদ দিয়ে বলা হয়েছে,"প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীকে স্যার বলার বাধ্য বাধকতা নেই, সরকারি কর্মচারিরা কি ভুলে যাচ্ছেন, তাঁদের বেতন ভাতা জনগণের ট্রাক্সের টাকায় হয়।" এ বিষয়ে ২৭ মার্চ,দৈনিক কালবেলা পত্রিকার এক পোস্ট এডিটোরিয়ালে তথ্য বহুল একটা নিবন্ধ প্রকাশ হয়েছে।" তাঁদের প্রতিটি লেখার মতামত যুক্তিযুক্ত। কিন্তু অফিশিয়ালিদের সাথে নন-অফিশিয়ালদের সম্বোধনসূচক শব্দ কি হবে? তা যেমন সংবিধান উল্লেখ নেই, তেমনি কর্মচারিদের সাথে জনগণের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সম্বোধনসূচক ভাষা কি, তাও কিন্তু জানা নেই, ফলে আমরা 'স্যার' শব্দটি হরহামেশাই ব্যবহার করছি। স্যার শব্দের অর্থ 'মহোদয়,' যে শব্দটি ব্যবহারে আমি-আমরা, তিনি-তাঁরাসহ অনেকেই অভ্যস্থ নই। 'স্যার' শব্দটি প্রচলিত এবং সহজ। এটি সম্বোধনের ক্ষেত্রে গ্রহণ করা যায়।

ধরে নিলাম, উদ্ধুদ্ধ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইন বা প্রজ্ঞাপন জারি করলেন, "প্রজাতন্ত্রের কর্মচারিদের সাধারণ জনমানুষ যা ইচ্ছে তা বলে সম্বোধন করতে পারবেন, এরমধ্যে 'ভাই, চাচা, মামা, খালু ইত্যাদি।" বিষয়টি কোন সভ্য দেশের জন্য মার্জিত হবে কি না?আবার কর্মচারিরা জনগনকে মহোদয় বলে সম্বোধন করবেন, এ বিষয়টির নেতিবাচক প্রভাব একজন ব্যক্তির পরিবার কিংবা শিক্ষা ক্ষেত্রে পড়বে কি না? বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কৃষি প্রধান বাংলাদেশের একজন কৃষক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। যে কৃষক সমাজকে দেশের সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, অধ্যাপক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, ছাত্র শিক্ষকরা স্যার বলবেন কি না? আমাদের জানা আছে, সরকারি চাকুরি আইন-২০১৮ অনুয়ায়ী এবং সংবিধানের ২১,১২০,১৩৪ ও ১৫২ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, "সেবাদানকারীরা 'কর্মচারী' 'কর্মকর্তা' নয়।"

তবে সেবাদানকারীকে সম্মান করলে সেবা গ্রহিতার যে সম্মানের ক্ষতি হবে না হয় না, তা সবাই বুঝতে না পারলেও শিক্ষক সমাজের বুঝা উচিত। অপরদিকে রাষ্ট্রের স্থানীয় কর্মচারীদের খেয়াল রাখা প্রয়োজন, তাঁরা রোড লেভেলের জন মানুষের সাথে কাজ করেন এক্ষেত্রে নানাজনের নানাবিধ আচার ব্যবহার তাদের মেনে নিতেই হবে। তাঁরা যে কোন রাজ্যের রাজত্ব করছেন না, তাঁরা যে মাটি, মানুষের সেবা দেবার মত মহৎ কর্মে নিয়োজিত তা সাধারণ জনগণ না বুঝলেও তাঁদের বুঝতেই হবে। পাঠককে কষ্ট না দিয়ে এবার 'অসাড়'নিয়ে বলছি। 'অসাড়' এর আভিধানিক অর্থ, অনুভূতিশুণ্য, অবশ, অজ্ঞান বা বোধশক্তিহীন।

জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন স্যার'কে ওইদিন অধ্যাপক স্যার কি বলে সম্বোধন করেছেন জানি না, তবে আমি একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে পারি, (Madam)ম্যাডাম শব্দটির অর্থ "ভদ্র মহিলা"। স্কুল কলেজে আমাদের নারী শিক্ষকদের, শিক্ষার্থীরা (Madam) ম্যাডাম বলে সম্বোধন করছে।আশ্চার্য! একজন শিক্ষককে তাঁর শিক্ষার্থী ম্যাডাম বলতে পারে না, কারণ ম্যাডাম কোন সম্মানসূচক শব্দ নয়।আমরা এতটাই বোধশক্তিহীন শিক্ষক যে, আমাদের শিক্ষার্থীদের আদব-কায়দা, কাকে কি বলে সম্বোধন করতে হয় তা শেখাতে পারি নি। সবকিছুই সংবিধান, আইন প্রনয়ণ কিংবা প্রজ্ঞাপন জারি করে হয় না, বিবেকই সভ্যতার বড় সংবিধান তা সবারই মনে রাখা জরুরী।

শিক্ষক: কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সংগঠক।