শিতাংশু গুহ


‘জাল-পরা বাসন্তী’ ছবিটি ২০টাকা দিয়ে তুলেছিলেন ইত্তেফাকের ফটোগ্রাফার আফতাব আহমদ। ছবিটি বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনে সহায়ক হয়েছিলো। আফতাব আহমদ জেলে যাননি। সাংবাদিকতার সুবাদে আমরা আফতাব আহমদকে ভালোই চিনতাম। শুনেছি পরে তিনি একুশে পদক পেয়েছেন। সাভারে শিশু দিনমজুর জাকির হোসেনকে ১০টাকা দিয়ে ‘আমাগো মাছ মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো’ বলিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শাম্স। স্বাধীনতা দিবসে অর্থাৎ ২৬শে মার্চ দৈনিক প্রথম আলো এ প্রতিবেদন ছাপায়। ২৯শে মার্চ ভোররাতে সিআইডি শামসকে বাড়ী থেকে তুলে নেয়?

শামসুজ্জামান শাম্স-র রিপোর্টটি ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ তা বলা বাহুল্য। তিনি সরকার বিরোধী তাও হয়তো অনুমেয়। ঢাকার মিডিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ট, আমার জানামতে বাংলাদেশে একজন মফস্বল সাংবাদিক কোন অবস্থাতেই তাঁর প্রেরিত সংবাদটি প্রকাশের ক্ষমতা রাখেন না? এ ক্ষমতা বার্তা সম্পাদকের, সম্পাদক উপস্থিত থাকুন বা না থাকুন তাঁর ওপর দায়িত্ব বর্তায়। একই কথা প্রকাশকের জন্যেও প্রযোজ্য। মামলা হতে পারতো প্রকাশক, সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, উচ্চ পদস্থ আরো কেউ, এরপর রিপোর্টার। এক্ষেত্রে একজন মফস্বল রিপোর্টারকে কেন এতটা গুরুত্ব দেয়া হলো কেজানে?

জাকির হোসেন শিশু, তার ‘চাইলের স্বাধীনতা চাই’ কথার যেমন কোন মূল্য নাই, ১০টাকা দেয়ার কথাও মূল্যহীন? কারণ আইনের দৃষ্টিতে জাকির অবুঝ। আমি ঘটনা অস্বীকার করতে চাচ্ছিনা, এখানে শিশু শ্রমিক জড়িত! ১৮ বছরের নীচে নাবালকের কথার কি মূল্য আছে? শামসুজ্জামানের মা কান্নায় ভেঙ্গে পরে বলেছেন, ‘আমার ছেলেকে রাতের বেলায় ধরে নেয়ার কি দরকার ছিলো, ডাকলে তো সে এমনিতে থানায় যেতো’। সচরাচর মফস্বল সাংবাদিকদের সাথে থানার ভালো সম্পর্ক থাকে, বোঝা যায় থানা এক্ষেত্রে ‘অপারগ’ ছিলো। সিআইডি বাড়াবাড়ি করেছে তা বলা অনাবশ্যক।

দেশে প্রচলিত আইনে এর বিচার হতে পারতো, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টের (ডিসিএ) প্রয়োজন ছিলোনা। এখানে ডিসিএ’র অপপ্রয়োগ হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই আইনের বিরুদ্ধে বহুদিন বলে আসছি, কারণ এটি সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে এবং এই আইনটি হিন্দুদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাসফেমি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার প্রতি ঘটনা এর দৃষ্টান্ত। এমুহুর্তে আমার বন্ধু, সহকর্মী শাহ আলমগীরের কথা মনে এলো, সরকার এবছর তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়েছেন, এজন্যে আমি খুশি। শাহ আলমগীর ‘প্রেস-ইনস্টিটিউটের’ মহা-পরিচালক ছিলেন। শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় প্রশাসন ‘প্রেস-ইনস্টিটিউটের’ প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করেছেন।

কবিগুরু গেয়েছেন, ‘রাজা যত বলে পারিষদ বলে শতগুন —’ এক্ষেত্রে পারিষদ সরকারকে খুশি করার জন্যে ‘ওভার-এক্ট’ করেছেন; ডেকে আনতে বলায় ‘বেঁধে নিয়ে এসেছেন’? শামসুজ্জামান শাম্সকে আমি চিনিনা, কিন্তু তিনি বিখ্যাত হয়ে গেছেন, দেশে যাই হোক, বিদেশে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অতি উৎসাহী সিআইডি সরকারকে বিপদে ফেলেছে। শামসুজ্জামান শাম্স-র বিরুদ্ধে যাহোক তবু একটি মামলা হয়েছিলো, কিন্তু নওগাঁর সুলতানা জেসমিন-র ক্ষেত্রে তো কোন মামলাই ছিলোনা। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় মৃত্যু’র একদিন পর! তবু তাঁকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। এটিও অতি উৎসাহী পারিষদের সৃষ্ট ঘটনা।

আমি ১৯৭৫ দেখেছি। সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু আমাকে নববধূ সুলতানা কামাল’র মৃত্যু’র কথা মনে করিয়ে দেয়! জগন্নাথ হল থেকে কার্জন হলে যাবার পথে তাকে আমরা প্রায় প্রতিদিন ভার্সিটি’র মাঠে সুলতানাকে দৌঁড়াতে দেখতাম। ১৫ই আগষ্ট ঘাতকের বুলেটে তিনি নিহত হন। অনেকদিন পর নওগাঁর আর এক সুলতানা বেঘোরে প্রাণ হারালো। শামসুজ্জামান শাম্স বা সুলতানা উভয় ঘটনায় বাড়াবাড়ি হয়েছে। দু’টি ঘটনা সরকারকে বিপাকে ফেলবে। অথচ দু’টি ঘটনাই নিয়ম মেনে হ্যান্ডল করা যেতো। যায়নি, কারণ ‘রিমোট কন্ট্রোল’ কার হাতে কেজানে? এই দু’টি ঘটনা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে যে, দেশ কি নিয়ন্ত্রণহীন? আরো একটি প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আসলে কাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে’? ‘জাল-পরা বাসন্তী’ বা ‘কিশোর জাকির’ ঘটনায় মিল আছে, ব্যতিক্রম হচ্ছে, ‘হাউ ইউ রিয়েক্ট’? পহেলা মে বিশ্বব্যাঙ্কের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা’র ওয়াশিংটন আসার কথা, এ সময়ে এধরনের ঘটনা ঘটা উচিত নয়!

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।