স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, যশোর : তৃতীয় লিঙ্গ কোনো অভিশাপ নয়। সমাজে নারী পুরুষের পাশাপাশি তাদেরও সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। তবে সেই অধিকারের কতটা ভোগ করতে পারে তারা। জন্মগ্রহণের পর বেড়ে ওঠার সাথে সাথে প্রথমেই নিগৃহের শিকার হতে হয় পরিবার থেকে। তারপর সমাজ থেকে বিতাড়িত হতে হয়। জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে নিজের সদ্য দেখতে শেখা চোখে বেঁছে নিতে হয় নিরাপদ আশ্রয়। লড়াই করতে হয় খাদ্যে ও বস্ত্রের জন্য। শিক্ষার জন্য সংগ্রাম করে শেষমেশ হেরে যায় অনেকেই। লোক লজ্বার ভয়ে, পয়সার অভাবে পায় না ভালো চিকিৎসা।

পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নে কাজ খুঁজতে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। অবশেষে ঠাঁই মেলে হিজড়া জনগোষ্টিতে। সেখানে গুরুমার কাছে নিজেকে হিজড়া প্রমাণিত করে, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে শুরু করতে হয় এক অন্য রকম জীবন। রাস্তায় রাস্তায়, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে টাকা, চাউল কুড়িয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হয় তাদের।

অথচ ছোট বেলায় এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের নিঃপাপ চোখে মুখে স্পষ্ট ছাঁপ ছিলো বড় হওয়া, মানুষের মত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন। পরিবার থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পেলে তারাও এক একজন সফল মানুষে পরিণত হতে পারত। তবে এমন হাজারটা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রচলিত গল্পের মাঝেও রয়েছে কিছু কিছু ব্যতিক্রম গল্প। কিছু কিছু সংগ্রামি জীবনের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।

তেমনি একখন্ড গল্প যশোরের নিলিশা সুলতানা নিল। তবে গল্পটি শুরু করার আগে আমাদের ভ্রান্ত একটি ধারণা সম্পর্কে একটু পরিস্কার হওয়া দরকার। তৃতীয় লিঙ্গ বলতে পুরুষ ও নারীর পাশাপাশি অন্য একটি লিঙ্গকে বোঝানো হয়। আমরা সচারাচার এটাকে হিজড়া বলে গুলিয়ে ফেলি। তৃতীয় লিঙ্গের ভিতর একটা শ্রেণিকে ট্রান্সজেন্ডার বা রুপান্তরিত নারী বলা হয়। এটি মূলত পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করার পরও যাদের ভিতরে নারী স্বত্তা বেঁচে থাকে। অর্থাৎ যারা পুরুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করার পরও নারীদের মত মন মানসিকতার অধিকারী হয়। এদের চাল, চলন, সাজ গোজ সব কিছুতেই নারীর ছাঁপ স্পষ্ট থাকে। আবার অন্য দিকে হিজড়া দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত একটি শব্দ। তারা শারীরিকভাবে ছেলে থাকে। কিন্তু তাদের জেন্ডার আইডেনটিটি হয়ে থাকে মেয়ে।

যশোরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের মৃত শাহজাহানের রুপান্তরিত মেয়ে নিলিশা সুলতানা নিল। বাবা পেশায় একজন রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক ছিলেন। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ৬ বছর আগে। এখন সংসারে রয়েছেন মা ফিরোজা বেগম, নিল আর একমাত্র ছোট ভাই। নিলের বড় ২ বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাইটি ঢাকার একটি বেসরকারি ভার্সিটিতে পড়াশুনা করছে কম্পিউটার সাইস্নে। নিলিশা সুলতানা নিল ছোট বেলা থেকে নারী সুলভ আচারণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে সার্জারির মাধ্যমে রুপান্তরিত নারীতে পরিণত হয়। প্রথমে পরিবার মেনে নিতে চাইনি। সমাজের কাছে হাসির পাত্র হয়েছেন। সহ্য করেছেন অপরিসীম মানসিক নির্যাতন। তারপরও নিজের মনকে প্রার্ধন্য দিয়ে রুপান্তরিত নারীতে পরিণত হয়েছেন। এই নিল অন্য ৫ টা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মত ভেঙ্গে পড়েনি। বরং সমাজের কাছ থেকে চ্যালেন্স গ্রহণ করেছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। শহরের বাদশা ফয়সাল ইসলামি ইউস্টিটিশনে লেখা পড়ায় হাতে খড়ি তার। তারপর ঘোপ সেবা সংঘ প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্থানীয় মাহমুদুল রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং আব্দুর রাজ্জাক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। স্নাতক ভর্তি হন সরকারি সিটি কলেজে অার্থনীতি বিভাগে। বর্তমানে তিনি স্নাতক শেষ করেছেন। পড়াশুনার পাশাপাশি পার্ট টাইম চাকুরি হিসাবে কাজ করছেন ফুড পান্ডায়। ২ বছর যাবদ ফুড পান্ডায় কাজ করে নিজের খরচ নিজে বহন করছেন। এর আগেও তিনি বেসরকারি এনজিও এ আইটি সেক্টরে কাজ করেছেন। চাকুরির ক্ষেত্রে সবাই তাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। বর্তমানে তিনি অর্পণ মানব কল্যাণ সংস্থার সাথে কাজ করছেন। এখান থেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য বিভিন্ন রকম ফান্ড ও কালচারাল প্রজেক্ট পায়। এই সংস্থাটি তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্টিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যে চাইলে সমাজে অবদান রাখতে পারে সে সব বিষয় তুলে ধরতে বিভিন্ন সময় ৩৫ টির অধিক পথ নাটক করেছে সংগঠনটি।

নিলিশা সুলতানা নিলের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, পুরো সার্জারি সম্পন্ন করে পরিণত নারী হওয়ার ইচ্ছা তার। আর ৫ টা মেয়ের মত স্বামীর সংসার করতে চান তিনি। পেশাগত স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি আরও জানান, পেশা হিসাবে পুলিশ উপ-পরিদর্শক হওয়ার ইচ্ছা তার।

নিলের শুরুর দিকে সংগ্রামের গল্প জানতে চাইলে অশ্রু ভেজা নয়নে জানান, প্রথম দিকে নিজের পরিবার, সমাজ কেউ তাকে সাপোর্ট করেনি। ইসলাম ধর্মের অনুসারী নিল ৬ বছর হলো নিজেকে পুরুষ থেকে নারীতে রুপান্তরিত করেছেন। ১৯৭১ সালের ২১ শে নভেম্বর পুরুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করা নিল সমাজের বদ্ধমূল ধারণাকে বদলে দিতে নিরালস ভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমাদের সমাজে নিলদের হিজড়া বলে গালি দেওয়া হয়। যৌন নির্যাতনের চেষ্টা করা হয়। একটু সহানুভূতি, একটু দৃষ্টি ভঙ্গি বদলালে নিলরাও বদলে দিতে পারে তাদের অভিশপ্ত জীবন। ঘুঁনে ধরা এই সমাজ ব্যবস্থার ভদ্রতার আঁড়ালে লুকিয়ে থাকা চরম অভদ্রতা, অমানবিকতা। দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রাখতে পারে নিলিশা সুলতানা নিলের মত হাজার হাজার রুপান্তরিত নারী।

(এসএমএ/এএস/এপ্রিল ১৮, ২০২৩)