প্রসেনজিৎ বিশ্বাস, নগরকান্দা : বাউশখালী বাজার সংলগ্নে শত বছর ধরে ঐতিহ্য রক্ষার্থে দাড়িয়ে আছে এ পরিবারের বসবাসের দালান কোঠা গুলো৷ যা আজও ইতিহাসের স্বাক্ষি হয়ে দাড়িয়ে আছে। সিংহ পরিবারের গোড়াপত্তন সম্পর্কে কোন ইতিহাস পাওয়া না গেলেও এই পরিবার শুরু থেকেই এ অঞ্চলে বিভিন্ন জনহিতকর কাজ-কর্মে লিপ্ত ছিলেন। ফরিদপুর সালথা উপজেলার বাউশখালী জমিদার বাড়ি আজ হতে প্রায় দেড় শতাব্দী পূর্বে ১৮৬৯ সালে এই পরিবারে জন্ম নেন যতীন্দ্ৰনাথ সিংহ।

তিনি ত্রিশ বৎসর বঙ্গীয় সিভিল সার্ভিসে (BCS) প্রশংসার সাথে প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরবর্তীতে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। অবসরের পর তিনি বিষয় কর্মে মনোঃনিবেশের পাশা-পাশি অবসর মতো সাহিত্য চর্চা করতেন এবং তাঁর রচিত অসংখ্য গ্রন্থ ছিলো বলে জানা যায় কিন্তু সেসব গ্রন্থ কারো সংগ্রহে পাওয়া যায়না! জীবদ্দশায় তিনি সনাতন ধর্ম প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে জনশ্রুতি আছে। ফরিদপুরের এক অংশ তিনি জমিদারিত্ব করতেন।

যতীন্দ্রনাথ সিংহ তাঁর স্ত্রী সরজনী সিংহ মতান্তরে সরোজিনী দেবী আমৃত্যু তাঁদের বাউষখালী তালুক এবং ফরিদপুর শহরে বসবাস করেছেন। পরবর্তীতে তাদের সমাধী বাউষখালী বা ফরিদপুরের কোথায় কিভাবে হয়েছে জানা যায়না !

যতীন্দ্রনাথ সিংহের একমাত্র পুত্র শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ সিংহ মতান্তরে সুরেন্দ্র মোহন সিংহ ১৮৯৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ডাক্টারী পাস করে তিনি কিছু কাল ফরিদপুর টাউনে চিকিৎসা কার্যে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩৯ খ্রীষ্টাবে তিনি স্ব-পরিবারে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। যতীন্দ্রনাথ সিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্ৰীযুক্ত সত্যজিৎ সিংহ (বৈদ্যনাথ বাবু) ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং কলকাতাতেই তাঁর শৈশব, কৈশর ও যৌবনের কিছুকাল অতিবাহিত করেন। ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীযুক্ত সত্যজিৎ সিংহ তাঁর স্ত্রী শ্রীমতি রেখা রাণী সিংহকে নিয়ে কলকাতা থেকে এসে বাউষখালী তালুকের সিংহবাড়ি তে বসবাস শুরু করেন। এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য সত্যজিৎ সিংহ নিজস্ব সম্পত্তিতে হাট-বাজার এবং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার বিস্তারের জন্য এলাকার অসচেতন লোকদেরকে উৎসাহিত করতেন। তিনি ব্যক্তিগত তহবিল হতে বৃত্তির ব্যবস্থাও করেন।

কৃষি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ পূর্বক উন্নত বীজ এবং পুরাতন চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তে নূতন পদ্ধতি এবং নূতন নূতন ফসল চাষাবাদে স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করণের সাথে সাথে সহযোগীতাও করেন। কৃষকদের সুবিধার্থে বাউষখালী খাল তিনি খনন করান এবং চিকিৎসা বঞ্চিত মানুষদের সহজ চিকিৎসা প্রাপ্তির লক্ষ্যে বাউশখালী বাজারের উত্তর পার্শ্বে ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ ও স্বাস্থ্য কেন্দ্ৰ স্থাপনের জন্য তিনি সরকারকে জমি দান করেন। সত্যজিৎ সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী রেখা রাণী সিংহ দূর্গোৎসব সহ সনাতন ধর্মীয় সকল পূজা-পার্বণ সিংহবাড়ি তে আয়োজন করতেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা দুজনেই শ্রীকৃষ্ণ অনুরাগী হয়ে সাধন-ভজন শুরু করেন, দূর্গোৎসব বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবছর চৌঠা ফাল্গুনে বাৎসরিক মহোৎসব শুরু করেন। যেখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু ভক্তবৃন্দের সমাবেশ ঘটতো।

মৃত্যুর পূর্বে কয়েক বৎসর ধরে সত্যজিৎ সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী রেখা রাণী সিংহ বাউষখালী সিংহবাড়ি ও তৎ সংলগ্ন ঠাকুর দালান রক্ষনা-বেক্ষন করারা জন্য। রাধাগোবিন্দের নামে তাদের সমুদয় সম্পত্তি দিয়ে যান। তখন থেকেই সনাতন ধর্মের মানুষ জন নিয়মিত পূজা রচনা করে আসছেন। দেশের বিভিন্ন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী এখানে ঘুরতে আসেন।

সত্যজিৎ সিংহ ২০১৩ খ্রীষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর বাউশখালীর নিজ বাড়ীতে দেহত্যাগ করেন এবং সিংহবাড়ি সংলগ্ন দূর্গা মন্দীরের পার্শ্বে তাঁকে সমাহিত করা হয় । জনশ্রুতি আছে যে, সত্যজিৎ সিংহের মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী রেখা রাণী সিংহ সিংহ বাড়িতে স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে পূণরায় দূর্গাপূজা শুরু করেন। এবং একই বছরে দূর্গাপূজা চলাকালীন মহাষ্টমীর দিন তিনি (২০১৫ খ্রীষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর) দুপুর বেলা দেহ ত্যাগ করেন । রেখা রাণী সিংহকে সিংহবাড়ি সংলগ্ন দূর্গা মন্দীরের পার্শ্বে তাঁর স্বামীর সমাধীর পার্শ্বে সমাহিত করা হয়। সিংহ বংশের কেউ কেউ ইন্ডিয়াতে বসবাসরত আছেন কিন্তু বাংলাদেশে সিংহ বংশের কেউ আর অবশিষ্ট নাই।

(পিবি/এসপি/এপ্রিল ২০, ২০২৩)