নাটোরের নির্যাতিতা সেই স্কুল শিক্ষিকার দায়িত্ব নিলেন জেলা আ. লীগের দুই শীর্ষ নেতা
গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু, বিশেষ প্রতিনিধি : নাটোরে জয়া আচার্য (২৭) নামের এক স্কুল শিক্ষিকা (বিধবা) বখাটেদের বিরুদ্ধে থানায় 'ধর্ষণ চেষ্টা'র মামলা করে যখন গত দুই সপ্তাহ ধরে সন্ত্রাসীদের হুমকীতে অনেকটা 'গৃহবন্দী' হিসেবে প্রচন্ড আতংকের মধ্যে দিনাতিপাত করছিলেন, ঠিক তখনই ওই আতংকিত স্কুল শিক্ষিকার জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দিলেন নাটোর জেলা আওয়ামীলীগের দুই জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি তথা দুই শীর্ষনেতা। গতকাল রাতে 'স্কুল শিক্ষিকা জয়া আচার্য এখনও নিরাপত্তাহীন, কেন? শীর্ষক 'নিউজ টোয়েন্টিফোর বিডি ওয়েবসাইড ও বিশের বাঁশী' আয়োজিত ভার্চুয়াল এক টকশোতে অংশ নিয়ে নাটোর জেলা আওয়ামীলীগের ওই দুই জনপ্রতিনিধি নির্যাতিতা জয়া আচার্যের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দেন।
বিশেষর বাঁশী সম্পাদক সাংবাদিক সুভাষ সাহার উপস্থাপনায় ওই ভার্চুয়াল টকশোতে অংশ নেয়া ওই দুই শীর্ষ জনপ্রতিনিধি হলেন নাটোর জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি ও নাটোর পৌরসভার মেয়র উমা চৌধুরী জলি এবং জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম রমজান। এছাড়াও ওই টকশোতে বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক নেতা অমিয় ঘটক পুলক ও দৈনিক বাংলা ৭১ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি গৌরাঙ্গ দেবনাথ অপু অংশ নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাটোর সদর উপজেলার দক্ষিণ আলাইপুর গ্রামের বাসিন্দা, উপজেলা সদরের কান্দিভিটা স্টুডেন্ট কিন্ডার গার্টেন স্কুলের ওই শিক্ষিকার নাম জয়া আচার্য (২২)। তার স্বামী দুই বছর আগে মারা যান। এ দম্পতির অনিন্দিতা নামে ৪ বছর বয়সি একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। প্রতিবেশীরা জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই সুশ্রী ওই জয়া আচার্যের ওপর কুনজর পড়ে স্থানীয় আনোয়ার হোসেন নামে এক বখাটের।
স্কুল শিক্ষিকা জয় আচার্য এ প্রতিবেদককে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জানান, 'আমার স্বামীর মৃত্যুর পরই বখাটে আনোয়ার হোসেন আমাকে প্রতিনিয়ত নানাভাবে উত্যক্ত করতে থাকে। স্কুলে যাওয়া আসার সময় আনোয়ার প্রায়ই আমাকে উত্যক্ত করার পাশাপাশি অনৈতিক কুপ্রস্তাবও দিত। এমনকি প্রায়ই বাসায় আসার চেষ্টা করতো। ফলে তার নানা কুপ্রস্তাব থেকে বাঁচার জন্য আমরা একাধিকবার বাসাও বদল করেছি। এরপরও আনোয়ারের কাছ থেকে কোনভাবেই রেহাই পাচ্ছিলাম না। '
জয়া আচার্য আরও জানান, ঘটনার দিন গত ৯ এপ্রিল দুপুরে সে আমাদের বাসায় আচমকা জোরপূর্বক ঢুকে আমাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ সময় আমার আর্তচিৎকারে লোকজন এগিয়ে এলে সে পালিয়ে যায়। পরে ক্ষুব্ধ হয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় সে তার দলবল নিয়ে আমাদের বাসায় পুনরায় এসে হামলা চালায়। এসময় আমার বাবা ও ভাই বাঁধা তিতে গেলে, সন্ত্রাসীরা আমার বাবা ও ভাইয়ের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাদেরকে মারধর করে। পরে বাসার যাবতীয় মালামাল তছনছ করে নির্বিঘ্নে বের হয়ে যায়।
এ ঘটনার পর আমি থানায় গিয়ে বাদী হয়ে আনোয়ার হোসেনকে 'প্রধান আসামি' করে ৫ জনের বিরুদ্ধে একটি ধর্ষণ চেষ্টার মামলা করি। এরপরই পুলিশ আনোয়ার ও তার সহযোগি রানা কে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠায়।
জয়া আচার্যের বাবা তপন আচার্য জানান, 'মামলা করার পর আনোয়ার সহ দুজন গ্রেপ্তার হলে, বখাটে আনোয়ারের সহযোগি গুন্ডা পান্ডারা প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে নানাভাবে আমাকে, আমার ছেলেকে ও মেয়ে জয়াকে হত্যার হুমকী দিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের হুমকীতে আমার মেয়ে ঘটনার পর থেকে দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে অনেকটা 'গৃহবন্দী' অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলো। সন্ত্রাসীদের ভয়ে মেয়েটি আর স্কুলেই যেতে পারছিলোনা। এমনকি ঘর থেকে কোথাও বের হতে সাহস পাচ্ছিলোনা। ঘটনার পর থেকে আমরাও সর্বক্ষণ ছিলাম আতংকে। মোটকথা সন্ত্রাসীদের ভয়ে আমার গোটা পরিবারটি এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম।'
প্রতিবেশীরা জানান, সন্ত্রাসীদের ভয়ে গত দুই সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে আতংকে ওই নির্যাতিতা স্কুল শিক্ষিকা ঘরের বাইরে বের হতে পারছিলেন না। লোকজন জানান, থানায় মামলা হওয়ার পর 'মূল আসামী'সহ দুইজন গ্রেপ্তার হলেও, গ্রেপ্তার হওয়া সন্দ্রাসী আনোযারের সহযোগি বখাটেদের নানান হুমকীতে গোটা হিন্দু পরিবারটি এতদিন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভূগেছেন।
জয়া আচার্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, 'শুনতেছি, ঈদের পর আনোয়ার নাকি জামিনে মুক্ত হয়ে এসে আমাদের সকলককে জলন্ত পুড়িয়ে মারবে। তাই এ অবস্থায় আমরা এখন কোথায় যাবো, কিভাবে এখানে থাকবো, সেটি নিয়েই চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছিলাম।'
এ অবস্থায় গতকাল রাতে ভার্চুয়াল টকশোতে অংশ নিয়ে জেলা আওয়ামীলীগের ওই দুই শীর্ষ জনপ্রতিনিধি বিধবা জয়া আচার্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং আজ সকালে তাঁরা স্থানীয় দুই কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে জয়া আচার্যের সর্বশেষ খোঁজ খবর নিতে জয়ার বাসায় ছুটে যান। সেখানে তাঁরা গিয়ে জয়ার বাবা মায়ের সঙ্গেও পরিবারটির নিরাপত্তা ও এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচারের প্রতিশ্রুতি সেন।
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামীলীগের দুই শীর্ষনেতা মেয়র উমা চৌধুরী ও উপজেলা চেয়ারম্যান শরীফুল ইসলাম রমজান উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, 'মেয়েটির নিরাপত্তাসহ মেয়েটিকে তার সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার যাবতীয় দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করলাম। সর্ত্রাসী আনোয়ার যাতে সহজে জামিনে বের হয়ে না আসতে পারে, আমরা সে বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলবো। এমনকি জয়ার একটি ভালো চাকরি পাওয়ার বিষয়েও আমাদের যা যা করা দরকার আমরা কার সবটুকুই করবো।'
তাঁরা বিষয়টি যথাযথভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরার জন্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদেরকেও ধন্যবাদ জানান।
এদিকে নাটোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এটিএম মাইনুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, 'দ্রুত সময়ের মধ্যে স্কুল শিক্ষিকা জয়া আচার্যের মামলাটির তদন্ত শেষ করে চার্জশীট প্রদানের জন্য ইতিমধ্যে পুলিশের সংশ্লিষ্টদেরকে প্রয়োজনীয় কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া মেয়েটি ও তার পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে দেখছে পুলিশ।'
(জিডি/এসপি/এপ্রিল ২৭, ২০২৩)