প্রবাস ডেস্ক : বাংলাদেশে যখনই সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে তখনই আপনারা ঐসব বীভৎস ঘটনার সচিত্র বিবরণী ছেপে দেশের জনগণকে অবহিত করেছেন, আমাদের পাশে থেকেছেন, এজন্যে যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের উদ্দেশ্য দেশে চলমান সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করতে  আপনাদের সাহায্য চাওয়া।  আপনাদের মাধ্যমে দেশের প্রগতিশীল মানুষজন, সাংসদবৃন্দ, মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সেনাবাহিনী, বি,জি,বি ও পুলিশ প্রধানদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে চাই যে, তাঁরা যেন দেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধ করতে সচেষ্ট হন।    

সাংবাদিক বন্ধুগন, ১৯৮৮ সালে এরশাদ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার ভিত্তিতে রচিত ১৯৭২ সালের শাষনতন্ত্রের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার অব্যবহিত পর দাউদকান্দি ঋষি পাড়ায় আক্রমণকারী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা ঘোষণা করেছিল “এই দেশ আবার পাকিস্তান হয়ে গেছে, কাফেরদের এ’দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।” তখন থেকে নিয়মিতভাবে সংখ্যালঘু বিরোধী সামপ্রদায়িক সন্ত্রাসের কার্যক্রমটি অব্যহত রয়েছে। উদাহরণ হিশেবে, ২০১২ সালে রামু, ২০১৩ সালে নন্দীরহাট, ২০১৬-তে নাসিরনগর, ২০১৭ সালে রংপুরের গঙ্গাছড়া, ২০১৯ সালে ভোলার বোরহানুদ্দীন , ২০২১ সালের পুজোয় দেশের বিভিন্ন জেলায এবং সম্প্রতি ঠাকুরগাঁয়ে সংঘটিত ঘটনাবলী সম্পর্কে আপনারা সম্যক আবগত আছেন, তাই সেগুলোর বিবরণ দেওয়া প্রয়োজন মনে করিনা। বাংলাদেশ থেকে দেশ থেকে সংখ্যালঘু নাগরিকদের বিতাড়নের উদ্দেশ্য ও কলা-কৌশল অভিন্ন, তাই সেই বিবরণও দিচ্ছি না।

আমারা আজ যা বলতে চাই সেটা হল, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে কারণ ১৯৭২ সাল থেকে এ’ পর্যন্ত কোন সরকারই সংখ্যালঘু নির্যাতকদের বিচার করেনি। ধর্মীয় মৌলবাদী এবং উগ্রপন্থী ঐসব নির্যাতনকারীরা জানে সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণ, খুন, বা সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাদের পুরো গ্রাম ধ্বংস করে উৎখাত করলেও ( ১৯৯২ সালের ১০ই এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের লোগাঙ) বিচার হবে না। তাই তারা তাদের ঘোষিত লক্ষ্য দেশকে আফগানিস্তানের মত একটি শারিয়া শাসিত ইসলামিক অমিরাতে রূপান্তরিত করতে নির্ভয়ে, কখনও কখনও সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগীতায় সংখ্যালঘু নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭২ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনাবলীর হোতাদের তদন্ত করে কোন তালিকা এখনও করা হয়নি; তবে ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংঘটিত বর্বর আক্রমানের ৫৮,০০০ কেইস লিপিবদ্ধ আছে মানকাধিকার কর্মী শাহরিয়ার কবিরের বই এবং জজ সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত প্রোব কমিশন রিপোর্টে। তৎপরবর্তী কালের হাজার হাজার ঘটনা বিশদভাবে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলোর অপরাধীদের তালিকা সরকারের কাছে রয়েছে। অথচ, আপনারা জানেন যে, ব্যতিক্রম হিশেবে হাতে গুনা যায় এমন কয়েকটি কেইসে অভিযুক্তদের ছাড়া, সরকার সচরাচর সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার করেনা?

অবিরাম এই বর্বর নির্যাতনে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ায় সংখ্যালঘুরা ১৯৭০ যেখানে ছিল ১৯.৭% আজ ২০২৩ সালে সেটা নেমে গেছে ৯.১%-এ; আর, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটা ১৯৪৭ সালে যেখানে ছিল ৯৮.৬% আজ ২০২৩ সালে সেটা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪৮%-এ।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচার হয়না, সেখানে সংখ্যালঘু সুরক্ষার জন্য কোন বিশেষ আইন নেই, এমনকি প্রচলিত আইনেও তাদের বিচার করা হয় না, দু’একটি লোকদেখানো ব্যতিক্রম ছাড়া। বন্ধুগন, আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত দলসমূহ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে, ওনার জোটভুক্ত দলের সাংসদবৃন্দ, এবং সরকারী কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে দাবি করে এসেছেন যে, তারা সেকুলার ডেমোক্র্যাসি এবং দেশের সকল নাগরিকের সম-অধিকারে বিশ্বাসী। যদি তাই হয়, তবে তাঁদের শাসনামলে এ’দেশে নির্যাতিত হয়ে সংখ্যা মানুষদের দেশত্যাগ করতে হবে কেন?

সরকার চাইলে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব। ২০২২ সালের পুজোয় অঘটন ঘটেনি, কারণ সরকার কঠোর ছিলো। বিচার এবং শাস্তির ভয় থাকলে মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীরা দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ও আদিবাসীদের ওপর সামপ্রদায়িক সন্ত্রাস চালাতে সাহস করবে না।

তাই মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী ও সংসেদের কাছে আমাদের দাবি এবং সনির্বন্ধ অনুরোধ তাঁরা যেন আগামী নির্বচনের আগেই সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করেন এবং অবিলম্বে চিহ্ণিত অত্যাচারী, সন্ত্রাসীদের বিচার শুরু করে দেশে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের বিপন্ন অস্তিত্ত সুরক্ষার টেকসই ব্যবস্থা নেন। আমরা মনে করি যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহন করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহ প্রক্রিয়াটা বন্ধ করা সম্ভব:

(১) বর্তমান সংসদে একটি সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন পাশ করা, যার অন্তর্ভুক্ত থাকা চাই (ক) হেইট স্পীচ্ ও ক্রাইম আইন, (খ) সংখ্যালঘু নির্যাতকেদের বিচারের জন্য প্রতি জেলায় একটি দ্রুত-বিচারের ক্ষমতা সম্পন্ন আদালত প্রতিষ্ঠা করা।

(২) জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করা।

(৩) বাতিল শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইনের সকল সম্পত্তি প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়া।

এছাড়া আমাদের অন্যান্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে (ক) ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনরুজ্জিবীত করা (খ) সাহাবুদ্দীন কমিশন রিপোর্টের সুপারিশ অনুযায়ী অবিলম্বে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা; (গ) একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন পূর্বক ২০০৬ থেকে এ’পর্যন্ত সংঘটিত সকল সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপরাধীদের তালিকা করে সংশ্লিষ্ট আদালতের কাছে হস্তান্তর করা; (ঘ) নির্যাতন প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের যথেষ্ট পরিমান ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসন ও শারীরিক মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা; (ঙ) একটি বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন করা; (চ) পার্বত্য ভুমি কমিশন ও অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইনের দ্রুত এবং যথাযথ বাস্তবায়ন; (ছ) দেবোত্তর সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ আইন;(জ) সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসমূহের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন; এবং (ঝ) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আদলে সংখ্যালঘু ধর্মীয় ফাউণ্ডেশেন গঠন।

সাংবাদিক বন্ধুগন, আমাদের দাবীনামার ১, ২, ও ৩ বর্তমান সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২০১৮-র নির্বাচনী ইশতেহারে ছিলো এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগুলো বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো গ্রহন করলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধ হতে বাধ্য। দেশের সংখ্যালঘু মানুষের সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা এবং তাঁদের সম-অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াটা মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের জন্য এবং গোটা বাঙালী জাতির জন্য নি:সন্দেহে একটি গৌরবের কাজ, এবং এটি সরকারের দায়িত্ব।

নুতন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পু-কে অভিনন্দন। তাঁর প্রণীত শাহাবুদ্ধিন কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নে আমরা তার সদিচ্ছা কামনা করি। সাংবাদিক বন্ধুগন, ধৈর্য সহকারে আমাদের কথা শোনার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।

(পিআর/এসপি/এপ্রিল ২৯, ২০২৩)