দিলীপ চন্দ, ফরিদপুর : ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে একাধিক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কিন্তু কোনোটিতেই নেই মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা। এর মধ্যে একটি- মধুখালী সুমি ক্লিনিক এন্ড নার্সিং হোম। ১০ শয্যা বিশিষ্ট এই ক্লিনিকটি চলছে ডাক্তার ও নার্স ছাড়াই। ভ্রাম্যমাণ ডাক্তার দিয়েই রোগী দেখানো হয়। এমনকি সিজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনও ভ্রাম্যমাণ ডাক্তার দিয়ে করানো হয়। তাছাড়া রোগীদের দেখাশুনা ও সেবাযত্ন করে থাকে আয়া ও ক্লিনিকটির স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তার নিজেই।

অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণে অনিয়মের মধ্যে দিয়ে চলছে উপজেলাটির ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। ভয়ে তাকে ব্যতিত অন্যকোনো ডাক্তার দিয়ে রোগী দেখান না ক্লিনিক মালিকেরা।

সরেজমিনে গিয়ে এমনই চিত্র ও তথ্য উঠে আসে। দেখা যায়, সুমি ক্লিনিকটিতে ৫জন রোগী ভর্তি রয়েছে। কিন্তু তাদের দেখাশুনা ও সেবাযত্নের জন্য নেই কোনো নার্স। সম্প্রতি এই ক্লিনিকে সিজার হওয়ার পর পেটে গজ, টিস্যু ও ক্লিপ রেখে সেলাই দেয়ায় যন্ত্রণায় রত্না বেগম নামে এক প্রসূতি মারা যায় বলে অভিযোগও রয়েছে।

ফরিদপুর স্বাস্থ্য বিভাগ অফিস সুত্রে জানা যায়, ১০ শয্যা বিশিষ্ট ক্লিনিকে কমপক্ষে ৩ জন ডিপ্লোমাধারী নার্সসহ ৬জন নার্স, ৩ জন ডাক্তারসহ সার্বক্ষণিক একজন রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (আরএমও) থাকতে হবে। অন্যথায় ক্লিনিকটি অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনেই এমন অনিয়মের মধ্যে দিয়ে চলছে মধুখালী সুমি ক্লিনিক এন্ড নার্সিং হোম।

জানা যায়, প্রায় দেড় বছর আগে অন্য একটি ক্লিনিক ক্রয় করে সুমি ক্লিনিক নামে রুপান্তর করা হয়। যার সার্বক্ষণিক ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকেন স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তার। এই ক্লিনিকের মালিকপক্ষ রয়েছে চারজন। যার মধ্যে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মো: মুরাদুজ্জামান (মুরাদ) সহ সুমি আক্তার, রহিত ও সাবিনা আক্তার রয়েছে। বিভিন্ন সময় অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ক্লিনিকটির বিরুদ্ধে। কিন্তু কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ।

অনুসন্ধানকালে ক্লিনিকটির স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তারের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়, রোগী এলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ডাক্তার আনা হয়। সকাল ও রাতে রাউন্ড দিয়ে থাকেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা অফিসার ডাঃ মো: আব্দুস সালাম। তাছাড়া অপারেশনের জন্য বা সিজারের জন্য ডাঃ মো: আব্দুস সালাম, ডাঃ শাহিন ও মাগুরা জাহান ক্লিনিকের মালিক ডাঃ মাসুদুল হককে ফোন করে ডেকে আনা হয়। কিন্তু অপারেশন শেষে একমাত্র শাহিন ডাক্তার ছাড়া আর কেউ স্বাক্ষর করেন না। অপারেশন শেষ করেই দ্রুত চলে যান টিএইচও ডাঃ মো: আব্দুস সালাম ও ডাঃ মাসুদুল হক।

এক পর্যায়ে সুমি আক্তার বলেন, অন্য কোনো ডাক্তার দিয়ে রোগী দেখালে টিএইচও ডাঃ মো: আব্দুস সালাম রাউন্ডে আসতে চান না। তাকে ব্যতিত অন্য কোনো ডাক্তার দিয়ে আমরা রোগী দেখাতে পারি না। এ সময় তিনি একজন আরএমও ডাক্তার আছে বলে জানান কিন্তু কোনো নাম বলতে পারেনি। এমনকি কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তাছাড়া ববিতা নামে একজন নার্স আছে বলে স্বীকার করেন কিন্তু তাকেও দেখাতে পারেননি। এক পর্যায়ে বলেন, নার্স ছুটিতে রয়েছে।

এদিকে গত ১৩ই এপ্রিল পেটে ব্যাথা নিয়ে এই সুমি ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে যান উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের মিটাইন গ্রামের মনিরুল ইসলামের স্ত্রী রত্না বেগম। এক পর্যায়ে তাকে সিজার করার পরামর্শ দেন ঐ ক্লিনিকের স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তার। পরে ঐদিন রাতেই তার অপারেশন করেন মাগুরা থেকে আসা ডাক্তার মাসুদুল হক। ঘটনার ১০ দিন পরে ২৩ এপ্রিল প্রসূতি মায়ের ব্লাডিং শুরু হলে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করেন স্বজনরা। ঐদিনই প্রসূতিকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার্ড করেন কর্তব্যরত ডাক্তার। এরপর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ও পেটে ইনফেকশনে ২৪শে এপ্রিল মৃত্যু হয় ঐ প্রসূতি মায়ের।

মৃত রত্মা বেগমের স্বামী মনিরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, তার স্ত্রীর পেটে গজ, টিস্যু ও ক্লিপ রেখে সেলাই করায় ১১দিন পর যন্ত্রণায় ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেছে। যেটা ঢাকা মেডিকেলে অপারেশনকালে ডাক্তাররা বের করেছেন।

এদিকে রত্না বেগমের সিজারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ডাঃ মাসুদুল হক। তিনি জানিয়েছেন, গত দেড় বছর যাবৎ মধুখালীতে যাওয়া হয় না, আমি কিভাবে সিজার করবো।

তবে ঐ ক্লিনিকের স্বত্ত্বাধিকারী সুমি আক্তারের দাবি ডাঃ মাসুদুল হক সিজার করেছেন কিন্তু তার কোনো স্বাক্ষর রাখা হয়নি।

এসব বিষয়ে ফরিদপুর সিভিল সার্জন রবিবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে এ প্রতিবেদককে বলেন, সুমি ক্লিনিকে সিজারের কারণে একজন রোগী মারা যাওয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু কোনো অভিযোগ পাইনি। তারপরও ঘটনাটি যাচাই করার জন্য টিএইচওকে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছি।

ঐ ক্লিনিকের অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা যখন সরেজমিনে যাই তখন তারা ডাক্তার ও নার্স দেখিয়ে থাকে। তখন কিভাবে ব্যবস্থা নেবো? তারপরও বিষয়টি যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(ডিসি/এসপি/মে ০১, ২০২৩)