চৌধুরী আবদুল হান্নান


গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ থাকায় এক প্রার্থীকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি কিন্ত কোনো লাভ হয়নি।

নির্বাচন কমিশনের এমন শক্ত অবস্থান ঋণ খেলাপিদের প্রতি নিঃসন্দেহে একটি শক্ত বার্তা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগী হতে পারে এবং তাতে নিশ্চিত সুফল পাওয়া যাবে।

নির্বাচনী এলাকায় সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামে খেলাপি ঋণ থাকলে তা নির্বাচন কমিশনে জানিয়ে দিতে হবে এবং অনুরোধ থাকবে খেলাপি ঋণ নিয়মিত না করে বা পরিশোধ না করে যেন নির্বাচনে অংশ গ্রহণকরতে না পারেন। প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থাকলে তারা ঋণ পরিশোধ করে ব্যাংক থেকে ছাড়পত্র নিতে বাধ্য হবেন। অনেক খেলাপি গ্রহীতা আছেন যারা ব্যাংকে এককালীন সামান্য কিছু টাকা (ডাউন পেমেন্ট) জমা দিয়ে ঋণ হিসাবটি রিসিডিউল করে সাময়িক নিয়মিত করে নেন। উদ্দেশ্য একটাই, নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার জন্য যোগ্যতা অর্জন।

আসন্ন সংসদ নির্বাচনে যেন কোনোভাবেই ঋণ খেলাপিরা অংশ নিতে না পারেন সে বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ ঋণ খেলাপিরা জনপ্রতিনিধি হতে পারেন না। সেক্ষেত্রে অন্য সকল ঋণ খেলাপিরাও একটু নড়ে চড়ে বসবে, ঋণ নিয়মিত করার তাগাদা অনুভব করবে।

এখনই মোক্ষম সময় ক্ষমতাশালী ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চান তাদের পাকড়াও করার, সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। এখানে ঋণ বিতরণকারী ব্যাংকের মূল দায়িত্ব পালন করতে হবে , অন্য কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যাংকের ঋণ আদায় করে দিতে আসবে না।

ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়, ব্যাংকগুলো কেবল তাদের সহযোগিতা নেবে। সরকার এখন নির্বাচন নিয়ে অতিরিক্ত ব্যস্ত , নির্বাচন কমিশনও একই কাজ নিয়েআছে। খেলাপি প্রার্থীর ঋণ আদায়ের উদ্যোগটা এককভাবে ব্যাংকারদেরই নিতে হবে।

খেলাপি ঋণের ভারে ব্যাংক ব্যবস্থা ক্রমশ দুরবস্থা থেকে পঙ্গুত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, কোনো কৌশলই কাজে আসছে না, তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ আত্মসাতকারী ও পাচারকারীদের কু-কর্মে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যত নিয়ন্ত্রণহীনতা আর রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যাংকগুলো আজ এক ধরনের ডাকাতের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশে একজন অব্যবসায়ী প্রভাবশালী ব্যক্তির ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নিতে তেমন বেগ পেতে হয় না এবং পরিশোধ না করলেও অসুবিধা হয় না। আর যার অনেক টাকা তার ক্ষমতাও অনেক, দেশের আইন কানুন তাকে সব সময় মেনে চলতে হয় না।তাদের দাপট-দৌরাত্ম্যে কেবল ব্যাংক পাড়াই অস্থির নয়, গোটা সমাজই অস্থির।

ঋণ খেলাপিরা সমাজের দুর্বল শ্রেনীভূক্ত নয়, তারা সবল শ্রেনীভূক্ত, অত্যন্ত ক্ষমতাধর, তাদের আটকানো সহজ নয়।

অতীতে দেখা গেছে, খেলাপি প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশন থেকে অযোগ্য ঘোষণা করার পরও তারা বসে থাকে না, অনেকেই আদালতে রিট আবেদন করে থাকেন এই মর্মে যে, কোনো একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাকে ঋণ খেলাপি বলা যাবে না।অনেক টাকার বিনিময়ে বিজ্ঞ-দক্ষ একাধিক আইনজীবী নিয়োগ দিয়েতর্ক-বিতর্কের অবতারণার মাধ্যমে আদালতের সময় ক্ষেপন করতে থাকেন। এরূপ কিছু ক্ষেত্রে রিটকারীর উদ্দেশ্যে আদালতের পর্যবেক্ষণ এমন হতে দেখা গেছে — “আগে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ পরিশোধ করেন, তারপর নির্বাচন করেন!”

ওদের আটকানো খুবই কঠিন কিন্ত সকল পক্ষ আন্তরিক হলে কাজটা অসম্ভব নয়। তবে ব্যাংকারদের আদা জল খেয়ে মাঠে নামতে হবে। এখানে খেলাপি ঋণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আদায় হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে নির্বাচনের এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কতটা সফলতা আসবে তা নির্ভর করবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকল ব্যাংকের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ওপর।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।