প্রথম পর্ব
মুক্তিযুদ্ধের উৎকর্ষে একাত্তরের জুলাই এবং বন্ধু প্রতীম ভারত
রহিম আব্দুর রহিম
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা। যা সারা বিশ্বের বিবেকে প্রচন্ড নাড়া পড়ে। ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনের রক্তবীজে প্রথিত হওয়া স্বাধীন বাংলার স্বপ্নে বিভোর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদক্ষ সাংগঠনিক কর্মপ্রচেষ্টা, দৃঢ়চিত্ত, দেশাত্মবোধ ও মুক্তিকামী মানুষের কাঙ্খিত বাসনা পূরণে যিনি গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে বন্দরে বিচরণ করেছেন। শোষকদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে । জেল জুলুম যাঁকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। তাঁর ৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ গোটা জাতি মনে প্রাণে গ্রহণ করেন। এই ভাষণের মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ২৫ মার্চে কালো রাতে নিরস্ত্র নিরীহ বাঙালিদের উপর পৈশাচিক হত্যাকান্ডে মেতে উঠে পাক হানাদার বাহিনী। হত্যা , ধর্ষণ খুনের হুলিখেলায় মত্ত পাকহানাদারদের সহযোগিতায় আত্মনিয়োগ করে দেশদ্রোহী রাজাকার আলবদর, আলশামস নামক নিমকহারাম গোষ্ঠী। শান্তি কমিটির নামে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ অবাধে চালায় এই পিশাচরা। হত্যা, ধর্ষণ এবং জীবনরক্ষায় মুক্তিকামী বাঙালিরা দলে দলে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে থাকে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সীমান্ত। পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ ও বর্বর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় এককোটি মানুষ আশ্রয় নেয় ভারতের মাটিতে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সর্বমোট ৯৮ লক্ষ ৯৯ হাজার ৩৫০ জন শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করে। বিপুল সংখ্যক এই ছিন্নমূল মানুষের দায়িত্ব নিতে হয় ভারত সরকারকে । যা ভারত সরকার এবং ভারতের সাধারণ মানুষের জন্য ছিল বড় একটা চ্যালেঞ্জ। যুদ্ধতাড়িত বাঙালির করুণ পরিনতি দেখে ভারতের সাধারণ জনমানুষ বাংলাদেশ স্বীকৃতির দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠে। উল্লেখ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত ভারতের ১হাজার ৩শত ৫০ মাইল সীমান্ত জুড়ে শরণার্থীদের ক্যাম্প গড়ে উঠে। মে মাস অবধি বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে ৩০ লক্ষাধিক বাঙালি আশ্রয় নেয়।
১৯৭১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে বিদেশী সাংবাদিকরা শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে এসেছিলেন বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার সাথে লাগোয়া ভারতে ত্রিপুরা রাজ্যের সাক্রম এলাকায়। বিদেশী সাংবাদিকদের মধ্যে একজন ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি সিডনি শনবার্গ। এই সাংবাদিককে কাছে পেয়ে সাক্রম এর একটি শরণার্থী ক্যাম্পের ৪৫ বছর বয়সী এক নারী তাঁর ১৬ বছর বয়স্ক তার দুই জমজ মেয়েকে ফিরে আকূতি জানায়। এই সাংবাদিক শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছিলেন ‘চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে যে নারী আমাকে বলেছিলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা তার বাড়িতে আগুন দিয়েছে; যখন তারা বের হয়ে আসছিল, তখন তাদের দুই মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে সৈন্যরা।’
আগেই উল্লেখ্য করা হয়েছে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতের বিভিন্ন সীমান্তে স্থাপিত বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলো। এর মধ্যে মে মাস নাগাদ ৩০ লক্ষ, জুলাই মাসে যার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৭০ লক্ষে, আগষ্টের শেষ নাগাদ যার সংখ্যা হয়েছিল ৯০ লক্ষ, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ যার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১ কোটিতে। পাকহানাদারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহীনির উৎকর্ষ পর্ব শুরু হয় জুনের শেষ সপ্তাহে, চলে সারা জুলাই মাস ধরে। জুলাই, চলছে ভরা বর্ষণ। যুদ্ধ, আতঙ্ক, ক্ষুধা এর উপর প্রাকৃতিক বর্ষণ ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের কি যে করুণ অবস্থা ! তা বর্ণনাতীত। জীবনমান রক্ষায় ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবিরে মানুষের ঢল সামলানো যাচ্ছে না।
ভারতের বিভিন্ন স্কুল কলেজ ছাত্রাবাস বন্ধ করে ভারতবাসী শরণার্থীদের জায়গা করে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানের অনেকেই তাদের বন্ধু বান্ধব,আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। প্রবল বর্ষণের মাঝেও অনেক শরণার্থী রাস্তার ধারে বসবাস করেছে। যারা বৃষ্টিতে ভিজে এবং রোদে শুকিয়ে অতীব কষ্টে দিন পাড় করেছে। তৎকালীন নিউইয়র্ক টাইমসের বর্ণনা অনুযায়ী অনেকেই কংক্রিটের পাইপের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে। পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য এসব পাইপ রাস্তার ধারে রাখা হয়। এই পত্রিকার বর্ণনায় আরও উঠে আসে, ‘পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল অনেকেই দেখা গেছে রাস্তার ধারে ভিক্ষা করতে, তারা এটাও বলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের স্রোত থামছেই না। প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে।
বার্তা এসোসিয়েটেড প্রেস এর এক খবরে বলা হয় ‘ শরণার্থীরা অনেকে ভারতে ঢোকার জন্য ৬০ থেকে ৭০ মাইল পর্যন্ত হেঁটেছেন। মাইলের পর মাইল ভারত পৌঁছেছিল অনেকেই। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় ‘পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৭৫ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন। শরণার্থীদের সামলানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিছু শরণার্থীকে ভারতের অন্য জায়গায় স্থানান্তরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন । এছাড়া ত্রিপুরায় ১৪ লাখেরও বেশি, মেঘালয়ে প্রায় ৭লাখ এবং আসামে ৩লাখের বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল। সবমিলিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের ভরা বর্ষণে জুলাই মাসের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কলেরা, ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। পুষ্টিহীনতা, বিশুদ্ধ পানির যোগান অসম্ভব হয়ে পড়ে।
(চলবে..)
লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক।