রহিম আব্দুর রহিম


১৯৭১ সালের মে মাসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থী পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে এক পত্র মারফত জানান ‘এখন পর্যন্ত ২০লক্ষেরও বেশি শরণার্থী ভারতে এসেছে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে । কারণ অনেকে রেজিস্ট্রেশন করেনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিনি আরও জানান, প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার শরণার্থী ভারতে ঢুকছে। এই চিঠির পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে চিঠি দেন। সেই চিঠিতে ইয়াহিয়া খান লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের যেসব নাগরিক আইন মেনে চলেন এবং যারা ভারতে যেতে বাধ্য হয়েছেন তারা যাতে দেশে ফিরে নিজেদের স্বাভাবিক জীবন শুরু করে সেজন্য আমি তাদের আহবান জানিয়েছি কিন্তু যারা অপরাধ করেছে তাদের আমি স্বাগত জানাতে পারবনা।’ পশ্চিমা দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদে উঠে আসে অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক প্রতিকুলতায় শরণার্থীরা দিন যাপন করছে। প্রতিদিন শরণার্থীদের মাঝে খিচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে। শরণার্থী সংকট তুলে ধরার জন্য সেপ্টেম্বর মাসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি চিঠি দিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা ব্রেজলেভকে। সে চিঠিতে মিসেস গান্ধী লিখেছেন, ‘ ভারত যখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির দিকে যাত্রা শুরু করেছে তখন সীমান্ত নতুন ধরণের আক্রমনের মুখোমুখি হয়েছে। এ আক্রমন কোন অস্ত্রধারীর কাছ থেকে নয় বরং অসহায়, ক্ষুধার্ত, অসুস্থ এবং সন্ত্রাসপিড়ীত মানুষের ¯্রােত যা ভারতে এসে ঠেকেছে। গত ৬মাসে এ সংখ্যা ৯০ লক্ষে। এ থেকে স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধের উৎকর্ষ সময় পার হয়েছে ‘জুলাই-আগষ্ট।’ এক দিকে বর্ষা অন্যদিকে ভারতমুখী শরণার্থীদের চাপ বৃদ্ধি। মিসেস প্রশ্ন তোলেন, ইতিহাস কি কখনও এত বড় শরণার্থী সংকট দেখেছে ? অনেক পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পায়নি। অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছে। ১৯৭১ এর নভেম্বর মাসে প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী বলেন,‘পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীরা ভারতের উপর সাংঘাতিক চাপ সৃষ্টি করেছে। শরণার্থী চাপের কারণে ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে দেয়া এক বক্তৃতায় গান্ধী বলেন, ‘এই সংকট সহ্যের সীমা সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে।’

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালো রাত থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিকামী জনতার যুদ্ধ ছিল নিরন্তর। তবে পৃথিবী প্রতিটি যুদ্ধের প্রারম্ভিকতা, উৎকর্ষ এবং গ্রন্থিমোচন বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তার ইকুয়াল ভ্যালু এসে ঠেকেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের জুলাই-আগষ্ট (উৎকর্ষকাল)। মুক্তিযুদ্ধের তথ্যচিত্র প্রমাণ করে ২৫ মার্চ থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের চরম উৎকর্ষ দেখা দেয়। একদিকে জীবন রক্ষায় দেশত্যাগী মানুষের ভারত পাড়ি জমানো, অন্যদিকে ভরা বর্ষায় শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে অবর্ণনীয় কষ্ট।

১৯৭১ সালে ১০ জুলাই দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন কানাডার সংসদীয় প্রতিনিধিরা। এসময় তারা ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, ‘কানাডা শরণার্থীদের পাশে সবসময় আছে। ইতোমধ্যে কানাডা সরকার শরণার্থীদের সহায়তার জন্য যে বরাদ্দ ঘোষণা করেছে তা শিগ্রই ভারতে পৌছাবে। কানাডা বিশ্বাস করে পূর্ব পাকিস্তান নামে কোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রাংশের অস্তিত্ব আর নাই।

বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। পূর্ব বাংলার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার দাবী জানিয়ে অন্যায় কিছু করেন নি। আমরা শরণার্থীদের সাথে কথা বলে যা শুনেছি, তা নিতান্তই পৈশাচিক ও নির্মমতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এটা এখন পরিষ্কার যে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংস করতে চেয়েছে।’ এই দিনই কলকাতায় ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে ১১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত শুরু হওয়া ৭দিন ব্যাপী সেক্টর কমান্ডার সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ৭ দিন ব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ।

সম্মেলনে মুক্তিবাহিনীর উচ্চপদস্থ কমান্ডারসহ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ১০ জুলাই প্রভাবশালী দৈনিক দ্যা ইকোনমিস্ট ‘মুক্তিবাহিনী এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়’ ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই মুহুর্তে মুক্তিবাহিনীর সকল কার্যক্রমই প্রায়ই সীমান্ত অঞ্চলেই সংঘঠিত হচ্ছে। পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসন আমাদের জানিয়েছে শুধু কুমিল্লাতেই মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ৮টি রেল সেতু ও ১৫টি সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকার উত্তরে মধুপুর বনাঞ্চলে নোয়াখালী, বরিশাল, খুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা ও নকশালপন্থি ভারতীয়রা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমন গড়ে তুলেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা ৫হাজার নতুন পুলিশ সদস্যকেও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য হিমশিম খেতে হচ্ছে। গত শুক্রবার ২জুলাই ঢাকার একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলার পর ঢাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। এর পরের দিন ঢাকা ময়মনসিংহ সড়কে একটি সেতু উড়িয়ে দিয়েছিল মুক্তিবাহিনী। বিহারী, জামায়তে ইসলামের সদস্য, মুসলিম লীগের নেতারা এখনও মুক্তিবাহিনীর নজরে আছে। সমস্ত বড় শহরে বোমা হামলা করেছে গেরিলারা। এরই মধ্যে শান্তি কমিটির ১০ সদস্য নিহত হয়েছে মুক্তিবাহিনীর হামলায়। তবে ছোট শহরগুলোতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

১০ জুলাই ঢাকার ধানমন্ডি ২নম্বর সড়কে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা দল পুলিশের উপর গ্রেনেড হামলা চালায়। এসময় এক পুলিশ অফিসারসহ ৫পুলিশ নিহত হয়। এই দিন (১০ জুলাই) ভেনিজুয়েলার কারাকাসে দ্যা রিলিজিয়ন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ দেখলে যীশু খ্রিস্ট নিজেও শিউরে উঠতেন। পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে তা কল্পনাকে হার মানায়।’ এই দিনই ব্রিটেনের লিস্টারে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যদের সই করা একটি ব্যাট বিক্রি হয়। এই ব্যাটটি ৭৭ পাউন্ডে কিনেন এক ভারতীয় প্রবাসী সমর্থক। ১০ জুলাই এই দিনই পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তান বাহিনী বেশ কয়েকটি ঘাঁটি পরিদর্শন করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি। এ সময় তার সঙ্গে স্থানীয় শান্তি কমিটির সভাপতিদের সাথে বৈঠক হয়। একই সঙ্গে এই দিন জেনারেল নিয়াজি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন । চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় জেনারেল নিয়াজিকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণের সকল স্থল ও নৌপথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে দুস্কৃতিকারীদের সম্পূর্ণরুপে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা পাকিস্তানের উপর কোন আঘাত সহ্য করতে পারিনা।’ একই দিন কুমিল্লার শালদা নদী এলাকার মঈনপুরে সুবেদার আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেনা বোঝাই একটি স্পীডবোডকে অ্যামবুশ করে। এতে দুজন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল, দুজন মেজর, তিনজন ক্যাপ্টেন, একজন নায়েব সুবেদার, তিনজন সিপাই ও একজন অবাঙালি ব্যবাসায়িসহ মোট ১২ জন নিহত হয়। ওই দিনের হামলায় কুমিল্লার জল্লাদ বলে পরিচিত ক্যাপ্টেন বোখারি নিহত হয়। এই দিন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঘোষণা করে সুবেদার ওয়াহাবের মরদেহ যে নিয়ে আসবে তাবে ৫০ হাজার টাকা পুরষ্কৃত করা হবে।’

একই দিন কুমিল্লার শালদা নদীর সাগরতলায় মুক্তিবাহিনীর উপর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী হামলা চালায় এসময় মুক্তিবাহিনী তীব্র আক্রমন গড়ে তোলে। মুক্তিবাহিনী মর্টার ও মেশিনগানের পাল্টা আক্রমনে ৪০ জনের মত হানাদার নিহত হয়। এ সময় বৃষ্টির মত গোলাগুলিতে হানাদার বাহিনী তাদের ক্যাম্পে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এইদিন নওগাঁওর মধইলে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার মকাই চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় ছয়জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

(চলবে..)

লেখক : শিক্ষক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক।