আনন্দ বেলা ডেস্ক


অনেক পুরনো দিনের গল্প এটা। তখন পৃথিবী মাত্র তৈরি হয়েছে। তখন পৃথিবীর রাজা ছিল হাতি। হাতিই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে বড়। দল বেঁধে হাতিরা আঁধার ঘেরা সবুজ বনভূমি মাতিয়ে বেড়াত। তখন পৃথিবীতে নদী ছিল না। বনের মাঝখানে ছিল ছোট্ট একটা পুকুর। বনের সকল পশুপাখি এসে সেই পুকুরে পানি খেত। পানি খাওয়ার সময় হাতি খুব আনন্দ করত। লম্বা শুঁড় দিয়ে সে পানি খেত। আর সে পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিত অন্যান্য পশুপাখির ওপর। হাতির ছিল দু-জন সঙ্গী। একজন বাজপাখি। অপরজন লালমুখো কাঁকড়া। হাতি একদিন তার সঙ্গীদের বলল, চল হে, একদিন আমরা শিকারে যাই। বনের গহন অঞ্চলে যাব। তোমরাও আমার সঙ্গে থাকবে। শিকারের কথা শুনে বাজপাখি মহাখুশি। সে সঙ্গে তীর-ধনুক নিয়ে নিল। আকাশের বুকে সে উড়ে উড়ে যাবে আর পশুপাখি শিকার করবে।

এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। কিন্তু কাঁকড়ার মনে খুশি নেই। কারণ সে জোরে ছুটতে পারে না। শিকারের অস্ত্রপাতি বহন করতে পারে না। তবু অনেক ভেবেচিন্তে কাকড়া ঠিক করল, সে-ও যাবে শিকারে। সে-ও শিকার ধরবে। একদিন সকালবেলা সবাই এসে জড়ো হল বনের ধারে সবচেয়ে উঁচু লম্বা গাছটার তলায়। তিনজনে মিলে তারা শিকারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। হাতি আর বাজপাখি তীর-ধুনক নিয়ে খুব দ্রুত এগিয়ে গেল বনের দিকে— যেখানে শিকার পাওয়া যাবে সেদিকে। কাকড়া বেচারা কী আর করবে? সে তো আর ঝটপট ছুটতে পারে না। বনের মধ্যে একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানে সে জাল দিয়ে ফাঁদ পেতে রাখল। হাতি আর বাজপাখি তীর ছুড়ে ঘায়েল করতে লাগল একের পর এক পশুপাখিদের। আহত পশুপাখিরা এসে কাকড়ার জালে আটকা পড়তে লাগল । হাতি আর বাজপাখি অবশ্য সরাসরি কোনো কোনো শিকারকে মেরে ফেলছিল।

আর যারা আহত হচ্ছিল সে-সব শিকার ধরা পড়ছিল কাঁকড়ার জালে। জালে আটকা পড়ে কেউ কেউ নড়াচড়া করতে চায়। কাঁকড়া তখন লাঠি হাতে দমাদম দু-চারটে বাড়ি মারে। তাতেই কম্বো কাবার। দিনের শেষে হাতি আর বাজপাখি দেখল— তারা ধরেছে মোট আটটি শিকার। হাতি পাঁচটি- আর বাজপাখি তিনটি। তারা ভাবল, যথেষ্ট হয়েছে। এবার ফিরে যাওয়া যাক।
কাকড়া কোথায় গেল?
জানতে চাইল হাতি।
হায়, বেচারা হয়তো একটাও শিকার ধরতে পারেনি। ফিরতি পথে তারা দেখে কারকাস গাছের পাশে বীরদর্পে বসে আছে কাঁকড়া। দশটা শিকার তার সামনে। সবগুলোর আকার-আয়তনও তাদের চেয়ে বড়। বাজপাখি কাঁকড়াকে দেখে অবাক। সে ধন্যবাদ জানাতে এগিয়ে এল। কিন্তু হাতির মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। কারণ সে রাজা। রাজার চেয়ে অন্যজনে বেশি শিকার করবে এ হতে পারে না। হাতি রাগে-হিংসায় চিৎকার করে উঠল, বাজপাখি, ওকেই এবার শিকার করতে হবে। আমি রাজা। ওর এত সাহস যে, ও রাজার চেয়ে বেশি শিকার করে। এ হতে পারে না।

এই মুহূর্তে ওর মাথাটা কেটে ফ্যাল। কাঁকড়া বুঝে ফেলল—ওর মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে বলল, রাজা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করবেন। এ-রকম ভুল আমার আর কখনও হবে না। আমায় মারবেন না দয়া করে। এই শিকারগুলো সব আপনার। যদি আপনি আমার প্রাণ ভিক্ষা দেন, আমি আর কখনও আপনার সামনে আসব না। শিকারগুলো পেয়ে রাজা খুব খুশি হলেন। কাঁকড়াকে আর হত্যা করলেন না। যাও, জলদি ভাগ এখান থেকে। আর কখনও যেন তোমাকে না দেখি। কাকড়া কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল। মাটির তলায় স্যাঁতস্যেতে বুনো ঝোপে গিয়ে সে আস্তানা গাড়ল। হাতি রাজা যেন ভুলেও তাকে দেখতে না পারে। সেই ঝোপে বসে বসে কাঁকড়া তখন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে লাগল। রাজা তাকে যে অপমান করেছে তা কখনও ভোলা যায় না। এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই হবে। একদিন হঠাৎ করেই কাকড়া গেল রাজার বাড়ি। দেখা হল হাতির বউয়ের সঙ্গে।রানিমা, শুভেচ্ছা নিন আমার। আমি এসেছি জরুরি একটা খবর নিয়ে।

আমাদের মহান রাজা খবর পাঠিয়েছেন। তিনি যেখানে শিকার করতে গিয়েছেন সেখানে আজ ভয়ানক ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডায় রাজা একেবারে জমে গিয়েছেন। তাই তিনি মরিচের ঝাল দিয়ে ঝোল তৈরি করতে বলেছেন। এখনই এসে পড়বেন তিনি। মরিচের ঝাল খেয়ে শরীরটাকে চাঙা করবেন তিনি। ভুলে যাবেন না রানিমা। তাহলে আমার গর্দান কাটা যাবে। হাতির বউ সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল। কড়া ঝাল দিয়ে মরিচের ঝোল রাঁধল সে। মাত্র রান্না শেষ হয়েছে এমন সময় হাতি আর বাজপাখি শিকার শেষে ফিরে এল ঘরে। তারা দু- জনেই খিদেয় কাতর। সারা দিন কম ধকল তো আর যায়নি। বউ, জলদি আমাদের খাবার দাও। খিদেয় আমাদের পেট জ্বলে যাচ্ছে। ওদিকে চালাক কাঁকড়া রানিকে রান্নার কথা বলেই চলে গেলে সেই পুকুরে যেখানকার পানি সব পশুপাখি খায়। পুকুর থেকে সব পানি সে সেঁচে মাটিতে ঢেলে দিল। পুকুরে আর একটুও পানি নেই। সব পানি তুলে ফেলা হয়েছে। হাড়ভাঙা খাটুনি করল বেচারা। তারপর শুকনো পুকুরের মাঝখানে একটা গর্ত করে কাকড়া সেখানে লুকিয়ে রইল। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তাকে। হাতি আর বাজপাখি খিদে পেটে ঢকঢক করে সবটুকু মরিচের ঝাল খেয়ে ফেলল। ঝালে তাদের মুখ-গলা-জিভ পুড়ে যেতে লাগল। আর প্রচণ্ড তেষ্টা পেল স্বাভাবিকভাবেই। চল, চল এখনই পুকুরে যেতে হবে আমাকে। হাতি চেঁচাতে লাগল।

আমি খুবই পিপাসার্ত। পানি না খেলে এখনই আমি মরে যাব। পুকুরে গিয়ে তারা অবাক। এতটুকু পানি নেই কোথাও। শুকনো খাঁ -খাঁ করছে সম্পূর্ণ পুকুরটা। দু-জনেই তারা এ অবস্থা দেখে ভীষণ রেগে গেল।
কী আশ্চর্য ব্যাপার।
হাতি বলল,
চল এখনই পুকুরটা খুঁড়ে দেখি। খুঁড়লেই পানি পাওয়া যাবে। তারপর দু-জন মিলে তারা পুকুর খোঁড়া শুরু করল। খুঁড়তে খুঁড়তে তাদের তেষ্টা আরও বাড়তে লাগল। হঠাৎ করেই খুঁড়তে ঘুড়তে কাঁকড়াটাকে পেয়ে গেল হাতিটা। পুকুরের পানি সরিয়েছিস তাহলে তুই-ই। রাগে হাতিটা দিশেহারা। —আর তোকে ক্ষমা করি আমি? বলেই সে কাঁকড়ার মাথাটা ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিল কাদায়। কাঁকড়ার ধড়টাও ফেলে দিল। ঠিক তখনই মাটির নিচ থেকে পানি বেরুতে লাগল। গল গল করে পানি বেরিয়ে আবার টইটম্বুর হয়ে উঠল পুকুরটা। হাতি আর বাজপাখির আনন্দ আর ধরে না।

তারা প্রাণভরে পানি খেতে লাগল। আনন্দে পানি ছিটাতে লাগল হাতিটা। নিজেদের শরীর, হাত-পা সব ধুয়ে নিল। কিন্তু পুকুরের পানি তখন উপচে পড়ছে। মাটির তলা থেকে পানি বেরুচ্ছে আর বেরুচ্ছে। পানিতে পুকুরটা এমনভাবে ভরে গেল যেন উপচে পড়ে বন জঙ্গল সব ভাসিয়ে দেবে। কী করা যায়? কী করা যায়? রাজা হাতি তখন বলল, ওহে বাজপাখি, পুকুরের ঢালু দিকটা কেটে দাও। যেন পানি গড়িয়ে যেতে পারে। বাজপাখি ভাবল এ আর এমন কী কাজ ! সে তার তীক্ষ্ণ ঠোঁট আর নখ দিয়ে পুকুরের ঢালু দিকটা কেটে দিল। তাতে পানি গড়িয়ে গেল বাইরে। পুকুরটা আরও লম্বা হয়ে খালের মতো হয়ে গেল। আর কয়েকদিন যেতে না-যেতেই সেই খাল আরও বড় হয়ে নদী হয়ে গেল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা বিশাল একটা নদী। আর সেই কাকড়াটা।

বেচারার মাথা নেই, তাই তার চোখও নেই। সে এখন নদীতে না পুকুরে সেটাও বুঝতে পারে না। তবে টের পায়, তার চারপাশে পানি আর পানি। মাছের কাছে যায় সে মাথাটা ফিরে পাওয়ার জন্য। কেউ তাকে মাথাটা দিতে পারে না। তবে চিংড়িমাছেরা তাকে কয়েকটা চোখ দিয়েছিল। তাই কাঁকড়ার মাথা না থাকলেও ঘাড়ে দুটো কুতকুতে চোখ আছে। তাই নিয়েই এখন সে আনন্দে আছে। কিছুক্ষণ নদীতে থাকে, কিছুক্ষণ পুকুরে থাকে। হাতি আর বাজপাখির আক্রমণের হাত থেকে সে এখন অনেক দূরে। আর পৃথিবীর প্রথম নদীটা আজও বয়ে চলেছে আফ্রিকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। পাহাড়ের কোলে ঘেঁষে আকাবাকা পথ বেয়ে নদী বয়ে চলে তার আপন গতিতে।

(ওএস/এএস/জুলাই ২২, ২০২৩)