মোঃ সিরাজ আল মাসুদ, টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে আনারসের উৎপাদন বাড়লেও বিক্রি কম হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। চাহিদা কম থাকায় পচনের ভয়ে কম দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে তাদের।পাইকার ও খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে আনারসের প্রাকৃতিক স্বাদ কমে ও স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়ে ক্রেতারা আনারস কেনা কমিয়ে দেওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে কিছু কৃষক নিরাপদ আনারস চাষে আগ্রহী হলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাদের মাঝেও দেখা দিয়েছে হতাশা। 

সচেতন কৃষকদের দাবি, আনারসে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে মুখ থুবড়ে পড়বে দৈনিক কোটি টাকা বাণিজ্যের এ ফসল। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, আনারসে ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার না করার জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

টাঙ্গাইল শহরের আদালত চত্বরে খুচরা আনারস ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান। আগে প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ পিস আনারস বিক্রি করলেও এখন সর্বোচ্চ ৮০ পিস বিক্রি করতে পারেন। তিনি বলেন, গত বছর যে আনারস ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি করতাম, সেই আনারসের দাম বর্তমানে ৩০-৪০ টাকা। আগের মতো আনারস বিক্রি হয় না।আনারসে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো আছে - এ ভয়ে এখন আর ক্রেতারা তেমন আনারস কিনতে চান না। এ কারণে দিন দিন আনারসের চাহিদা ও দাম কমছে। তাছাড়া, আনারসের আদি স্বাদ না থাকায় ক্রেতারা অন্য ফলে ঝুঁকছেন।

চৈতী, মঞ্জু মিয়াসহ কয়েকজন আনারস ক্রেতা বলেন, আগে প্রতি সিজনে ৮-১০টি আনারস কিনে খেতাম। এখন রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং প্রাকৃতিক স্বাদ নষ্ট হওয়ায় খাদ্য তালিকা থেকে আনারস বাদ দিয়েছি।

আনারসের প্রতি সাধারণ ক্রেতাদের এই অনাগ্রহ কয়েক বছর ধরেই টের পাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকপ্রাপ্ত আদর্শ কৃষক মো. ছানোয়ার হোসেন। তিনি মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামে ১৪ বিঘা জমিতে আনারসের চাষ করেছেন। তার মতো আরও কিছু সচেতন কৃষক শুরু করেছিলেন নিরাপদ ফল ও ফসল উৎপাদন।

ছানোয়ার হোসেন বলেন, আমার ১৪ বিঘা জমিতে ৬০ হাজার পিসের মতো আনারস পাবো। কিন্তু, দাম না থাকায় ক্ষতির শঙ্কায় আছি।

তার অভিযোগ, অনেক অসাধু চাষি বেশি লাভের আশায় আনারস বড় করতে ও পাকাতে হরমোন ব্যবহার করে থাকেন।

সরেজমিনে মধুপুরের গারো বাজারে গিয়ে দেখা যায়, মধুপুর, ঘাটাইল ও ফুলবাড়িয়া উপজেলার অন্তত ৩০ গ্রামের পাঁচ শতাধিক চাষি দলবেঁধে সাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভ্যানে করে আনারস নিয়ে এসেছেন। এ পাইকারি বাজারে ১০০ পিস আনারস আকারভেদে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন ভোরে শুরু হওয়া এ বাজার চলে বেলা ১১টা পর্যন্ত। প্রতিদিন প্রায় ৩৫ থেকে ৪৫ লাখ টাকার আনারস এই বাজারে বিক্রি হয়। পরে তা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যায়।

পাইকারী ব্যবসায়ী শফিক ও নিলয় জানান, তারা এই বাজার থেকে আনারস কিনে ট্রাকে করে ঢাকা, কুমিল্লা ও সিলেটে নিয়ে বিক্রি করেন। আগে যে পরিমাণ আনারস বিক্রি করতে পারতেন, এখন তা হয় না। আগে সপ্তাহে ১০-১২ ট্রাক আনারস বিক্রি করলেও এখন ৪-৫ ট্রাকের বেশি বিক্রি করতে পারেন না।

গারো বাজার বণিক সমিতির সভাপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, প্রতি সিজনে এই বাজারে ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার আনারস বিক্রি হয়। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর আনারসের দাম অনেক কম।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইল জেলায় ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর উপজেলাতেই ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর। গত বছরের তুলনায় ১৪০ হেক্টর বেশি। এবার ৪ হাজার ৮৮ হেক্টরে জায়েন্ট কিউ, ২ হাজার ৭৪০ হেক্টরে হানিকুইন এবং ১২ হেক্টর জমিতে নতুন জাতের এমডি-২ আনারস চাষ হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক নজরুল ইসলাম বলেছেন, টাঙ্গাইল জেলায় প্রায় ৮ কোটি পিস আনারস উৎপাদন হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১১৬ কোটি টাকা। আনারসে হরমোনসহ ক্ষতিকর কীটনাশক না মেশাতে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

(এসএম/এসপি/আগস্ট ১৪, ২০২৩)