দেবেশ চন্দ্র সান্যাল 


তদানীন্তন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমা (বর্তমানে জেলা) শাহজাদপুর উপজেলার পোঁতাজিয়া গ্রামের প্রণতি মৈত্রের বিবাহ হয়েছিল পাবনা জেলার কাশিনাথপুর থানার কাবারী খোলা গ্রামে। স্বামীর নাম- প্রভাত কুমার মৈত্র, পিতা-অমূল্য চরণ মৈত্র, মাতা-সুরুচি বালা মৈত্র এর সাথে। এলো ১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ’৭১ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্য স্বাধীনতা বিরোধীদের সহযোগিতায় সারা দেশ ব্যাপী জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, জোর করে ধর্মান্তর করন, লুটতরাজ, চাঁদা বাজি ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী নৃশংসতম কাজ করলো। তখন মৃত্যুঞ্জয়ী প্রভাত কুমার মৈত্র ছিলেন চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা ফুড অফিসের ইন্সপেক্টর। বাসা নিয়ে থাকতেন চাপাইনবাবগঞ্জ শহরে। 

৩ মে’৭১ দিনে কয়েক জন স্বাধীনতা বিরোধীর সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করলো। প্রকাশ্য দিবা লোকে জঘন্যতম অত্যাচার ও নির্যাতন করলো। কয়েক দিন নাটোর ও রাজশাহী জেল খানায় আটকে রাখলো। রাজশাহী থেকে নিয়ে এলো ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলখানায়।

একদিন প্রভাত কুমার মৈত্রকে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা জেলখানা থেকে বের করে নিয়ে গেল। এর পর আর প্রভাত কুমার মৈত্রের করুন পরিনতির কথা জানা যায় নাই। ১৬ ডিসেম্বর’৭১ পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের আত্ম সমপর্ণের মাধ্যমে দেশে বিজয় দিবস এলো। এলেন না প্রভাত কুমার মৈত্র। ঢাকায় রায়ের বাজার বধ্যভূমি, মিরপুর জল্লাদ খানা ও অন্যান্য বধ্যভূমিতে খোঁজ করেও তাঁর লাশ পাওয়া যায় নাই। প্রভাত কুমার মৈত্রের স্ত্রী প্রণতি মৈত্র (রানী গোস্বামী) তাঁর দুইটি শিশু কন্যা (১) মনিষা মৈত্র ও (২) শুভ্রা মৈত্র কে নিয়ে অসহায়ের মত এসে আশ্রয় নিলেন একমাত্র ভাই পোঁতাজিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক অনন্ত লাল গোস্বামীর পরিবারে। আশায় বুক বেঁকে থাকলেন প্রভাত কুমার মৈত্র ফিরে আসবেন ভেবে। তিনি বিধবার বেশ ধরলেন না।

স্বামীর মঙ্গল কামনায় শাখা সিন্দুর ব্যবহার করতে থাকলেন। বোন আর ভাগ্নিদের ভরন পোষন আর দায়িত্ব পালনের জন্য আজীবন বিবাহ করলেন না অনন্তলাল গোস্বামী। পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করার পরও যখন ফিরে এলেন না প্রভাত কুমার মৈত্র তখন তাঁর স্ত্রী প্রণতি মৈত্র সনাতন ধর্ম রীতি অনুসারে শাখা ভেঙ্গে শ্রাদ্ধাদি করে বিধবার বেশ ধরলেন। প্রভাত কুমার মৈত্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, পরোপকারী ও ধার্মিক। পাকিস্তান আমলে যখন পাকিস্তানি বাঙালিদের এ দেশে তেমন চাকরি হতো না তখন তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ফুড ইন্সপেক্টর পদের চাকরি পেয়েছিলেন। স্বামী আসবেন- ভাবতে ভাবতে দুশ্চিন্তা আর শোকে দুঃখে ২১.০৭.২২ ইং তারিখে প্রনতি মৈত্র চলে গেলেন না ফেরার পথে। রেখে গেছেন দুই পিতা- মাতাহীন কন্যা মনীষা মৈত্র ও শুভ্রা মৈত্র কে। মনীষা মৈত্র ও শুভ্রা মৈত্র জ্ঞান হওয়ার পর তাদের বাবাকে দেখে নাই। জীবনে বাবা বলে ডাকতে পারে নাই। তারা আজো বিশ্বাস করতে পারে না তাদের বাবা মারা গেছেন।

লেখক : বীরমুক্তিযোদ্ধা।