শীতকালে শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের করণীয়
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
২০ নভেম্বর সোমবার আন্তর্জাতিক শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ‘বিশ্ব শিশু দিবস ২০২৩। ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর বিশ্ব নেতারা শিশু অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়ন করেন। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যাপকভাবে অনুমোদিত মানবাধিকার চুক্তি। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে শিশু দিবস পালন করা হয়। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সাল থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনটিকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আর অক্টোবরের প্রথম সোমবারকে ধরা হয় বিশ্ব শিশু দিবস। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জুনের এক তারিখ শিশু দিবস। আর সার্বনীন শিশু দিবস নভেম্বরের ২০ তারিখ। শিশু অধিকার সনদের আলোকে শিশুদের জন্য এবং শিশুদের নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইউনিসেফ বিশ্ব শিশু দিবস পালন করে। এই দিনে ইউনিসেফ শিশুদের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো সমাধানে সমর্থন আদায় করে, শিশু অধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ায় এবং প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করে।পৃথিবীর প্রত্যেক শিশু যেন ন্যূনতম জীবন যাপন করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবারই। এজন্য শিশুদের সুযোগ দিতে হবে নানা ক্ষেত্রে। এমনকি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও। তাতে শিশু যেমন নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারবে, তেমনি সমাজের প্রতি তার দায়িত্ববোধের জায়গাও তৈরি হবে। এতে করে শিশুরা নিজেদের অবস্থানকে শক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে, নিজের জন্য, অন্য শিশুর জন্যও।
মানবজাতির মধ্যে সবচেয়ে অসহায় হচ্ছে শিশুরা। বড় হয়ে ওঠার জন্য বড়দের উপর শিশুদের নির্ভর করতেই হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, দুনিয়ায় যেকোনো দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। সে দুর্যোগ প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম- যে রকমই হোক না কেন। তার ওপর রয়েছে অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের প্রতি বড়দের দায়িত্বশীলতার ঘাটতি, সঠিক মনোযোগ এবং সঠিক পরিচর্যার অভাব।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশুদের প্রতি অবহেলাটা একটু বেশিই। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা যুদ্ধকালে শিশুদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ যে ভুল পথে পরিচালিত হয়, সেটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
শিশুদের প্রতি দায়িত্ববোধ তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনেকেই করেছেন। কিন্তু দেশ ও জাতির জন্য শিশুর প্রয়োজনীয়তার অনুভবটা নগদানগদি হয় না বলে, সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবনা চিন্তাও করা হতো না একসময়। তবে সময় বদলেছে।
বড়রা বুঝতে পেরেছে এবং জেনেছে যে, আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। চারাগাছ থেকে যেমন সহসাই ফল-ফল মেলে না, সুমিষ্ট ফলের জন্য এবং সুবাসিত ফুলের জন্য চারাগাছকে যেমন অতি যত্নে লালন-পালন করে বড় করে তুলতে হয়, তেমনি শিশুদেরও যত্ন প্রয়োজন। শিশুর প্রতি এই যত্নের গুরুত্ব থেকেই শিশু দিবসের জন্ম।
শিশু দিবসের জন্মের গুরুত্বটা কাগজে-কলমে প্রথমে বুঝেছিলেন ড. চার্লস লিওনার্দো ১৮৫৭ সালে। তখন তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের চেলসিয়ার ইউনিভার্সাল চার্চের যাজক। জুনের দ্বিতীয় রোববার শিশুদের যত্নের জন্য দিনটি বিশেষভাবে নির্ধারণ করেছিলেন তিনি।
লিওনার্দো দিনটির নাম দিয়েছিলেন রোজ ডে বা গোলাপের দিন বলে। পরে দিনটি ফ্লাওয়ার সান ডে বা ফুলেল রোববার নামে পরিচিত হয়। তারও পরে দিনটিকে চিলড্রেনস ডে যে বা শিশুদিবস হিসেবে অভিহিত করা হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম শিশুদিবস পালনের কৃতিত্ব তুরস্কের। ১৯২০ সাল থেকে রীতিমতো ছুটি দিয়ে তুরস্কে ২৩ এপ্রিলকে শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হতো। যদিও সেটা কোনো রাষ্ট্রীয় ঘোষণার মধ্যে ছিল না। তুরস্কের জাতির জনক কামাল আতাতুর্ক রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুদিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন ১৯২৯ সালে। আন্তর্জাতিকভাবে শিশুদিবসের ঘোষণা সামনে আসে ১৯২৫ সালে জেনেভায় বিশ্ব সম্মেলনে।
১৯৪৯ সালের ৪ নভেম্বর রাশিয়ার মস্কোতে অনুষ্ঠিত ওমেন্স ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফেডারেশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১ জুনকে বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৫০ সাল থেকে অনেকগুলো কমিউনিস্ট ও সাম্যবাদী দেশে ১ জুন থেকে শিশুদিবস পালন শুরু হয়ে যায়।
১৯৫৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভারত ও উরুগুয়ের উদ্যোগে একটি প্রস্তাব পাস হয়, যাতে বিশ্বের সব দেশকে শিশুদিবস পালনে উৎসাহিত করা হয়। তবে এই শিশুদিবস পালনের মধ্যে ছিল প্রথমত শিশুদের মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান ও বোঝাপড়ার প্রচার করা ও দ্বিতীয়ত জাতিসংঘ সনদের আদর্শ এবং বিশ্বের শিশুদের কল্যাণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৯৫৯ সালের ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের শিশু অধিকার ঘোষণা গৃহীত হয়। ২০ নভেম্বর থেকে বিশ্ব শিশু দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভিন্ন তারিখে শিশু দিবস পালন করে। বাংলাদেশে শিশু দিবস পালিত হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চে। তবে শিশু অধিকার ঘোষণার দিবস হিসেবে ২০ নভেম্বরের গুরুত্ব অবশ্যই অপরিসীম। কারণ এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই বিশ্বজুড়ে শিশু অধিকার সৃষ্টির সচেতনতা শুরু হয়। সে হিসেবে আজ ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি শিশু। তার মধ্যে আবার ১৫ শতাংশের বেশি শিশু দরিদ্র। আর অতিমারি করোনোর কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় এর প্রভাব পড়েছে তিন কোটি ৭০ লাখেরও বেশি শিশুর উপর।
ওদিকে ওয়ার্ল্ড ভিশনের জরিপে জানা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিশ্বের ৯১ শতাংশ শিশু ও তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। আমাদের শিশুরাও এ পরিস্থিতির বাইরে নয়। ইউনিসেফের এক গবেষণায় জানা যায়, ২০২০ সালের মহামারির পর থেকে বাংলাদেশে কিশোরীদের বিয়ের হার বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশের হাসপাতালগুলোয় তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশু ভর্তি হয়েছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ২০২১ সালে এসএএমে ভোগা শিশু ভর্তি হয়েছে ১১ হাজার ৩১৩ জন। যেখানে আগের বছর ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৫৭০।
অপুষ্টিকে দেখা হয় শিশুর শারীরিক ও মানসিক উন্নতির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শিশুর অপুষ্টি এখনো মারাত্মক একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যার দিক থেকে এখনো ওপরের তালিকায় বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, মারাত্মক তীব্র অপুষ্টি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। সারা বিশ্বে প্রায় ২ কোটি শিশু তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়। আর ১০ লাখের মতো শিশুর মৃত্যু হয়। এসব শিশুর অধিকাংশই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দা।
মহামারির ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার শিশুরা। মহামারিতে বেড়ে গেছে শিশু নির্যাতন, শিশুশ্রম, বাল্যবিয়ে, অপুষ্টি। এজন্য শিশু অধিকার ও সুরক্ষায় প্রত্যেকের অবস্থান থেকে নজর দেয়া জরুরি। এর পাশাপশি সাংবিধানিক অঙ্গীকার অনুযায়ী সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে শিশুর সৃজনশীলতা বিকাশ এবং আনন্দময় পরিবেশে শিশুকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখী শিক্ষায় গড়ে তোলাও জরুরি।
শিশুদের প্রতি সচেতনা তৈরির এই জরুরি কাজটা করবে কারা? এককথায় সমাজের সবাই। শিশুর বাবা-মায়ের পাশাপাশি শিক্ষক, নার্স ও ডাক্তার, সরকার, সমাজকর্মী, ধর্মীয় ও কমিউনিটির প্রবীণ, কর্পোরেট মোগল, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, তরুণ সমাজ এবং সর্বোপরি শিশুদের নিজেদের। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই শিশুর জন্য দেশ, জাতি-সমাজ হবে সুন্দর ও সাবলীল।
শিশু দিবসের জাতিসংঘের চাওয়া শিশুকে শিশুর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দেয়া। এতে করে শিশুরা নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান করবে জাতিতে, গোষ্ঠীতে। নিজেরা নিজেদের উৎসাহ দেবে, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে।
আর এসবের মাধ্যমে এই শিশুরাই একদিন হয়ে উঠবে সমাজ-সচেতন, রাষ্ট্র-সচেতন, সর্বোপরি অধিকার সচেতন। বিশ্বে পনেরো কোটিরও বেশি পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে যুক্ত। যা জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থি, শিশু অধিকারের পরিপন্থি। করোনা ভাইরাসের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত শিশুদের জীবন আরও বেশি সংকটময়। সে কারণে এবার শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘প্রত্যেক শিশুর জন্য চাই উন্নত ভবিষ্যৎ’।
পৃথিবীর প্রত্যেক শিশু যেন ন্যূনতম জীবন যাপন করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সবারই। এজন্য শিশুদের সুযোগ দিতে হবে নানা ক্ষেত্রে। এমনকি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও। তাতে শিশু যেমন নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে বুঝতে পারবে, তেমনি সমাজের প্রতি তার দায়িত্ববোধের জায়গাও তৈরি হবে। এতে করে শিশুরা নিজেদের অবস্থানকে শক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে, নিজের জন্য, অন্য শিশুর জন্যও।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, শিশু অধিকার তৈরির জন্য অভিনব কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে যেমন রয়েছে, একদিনের জন্য কোনো শিশুকে কোনো শহরের মেয়র কিংবা, পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তা বানিয়ে দেয়া। কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় বসানো।
বাংলাদেশেও এমন অভিনব উদ্যোগ শুরু হয়েছে। যেমন কন্যা শিশু দিবসে রংপুর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পেয়েছিল এসএসসি পরীক্ষার্থী বৈশাখী। আর বিশ্ব শিশু দিবস হিসেবে দেশের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে একদিনের সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে ঢাকার হলিক্রস স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী রূপকথা রহমান।
এটুকুতেই বসে থাকলে চলবে না। শিশুকে এরকম আরও ব্যতিক্রমী সুযোগ করে দিতে হবে। এরকম ব্যতিক্রমী উদ্যোগ শিশুকে তার ভবিষ্যতের কর্মপন্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা দেবে, তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে, তেমনি শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথাও মনে করিয়ে দেবে। মনে করিয়ে দেবে শিশুরাও এই পৃথিবীর কেবল অংশীদারই নয়, ভবিষ্যতের পৃথিবীটাও তো এক সময় শিশুদের হাতেই থাকবে।
শীতকালে শিশুদের রোগ-বালাই
সাধারনত ঋতু পরিবর্তনের প্রভাব কম বেশি সবার উপরেই পড়ে। ঋতু পরিবর্তনে বিভিন্ন অসুখের প্রকোপ বাড়ে। বিশেষ করে শীতকালে শিশুরা অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে।আর শীতে ছোট-বড় সবার শরীরের জন্যই প্রয়োজন হয় বাড়তি যত্নের। কারণ এসময় আবহাওয়া শুস্ক থাকায় ত্বকের নানা সমস্যা দেখা দেয়। শরীরের ভেতর-বাইরেও দেখা দেয়া নানা সমস্যা। বিশেষ করে আপনার সোনামনিকে সুস্থ রাখতে হলে প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা, বাড়তি যত্নের। হয়তো এসব ব্যাপারে আত্মীয়-স্বজন বা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে আমরা অনেক পরামর্শ পেয়ে থাকি। কিন্তু সবক্ষেত্রে সব পরামর্শ সঠিক নাও হতে পারে। আর এতেই দেখা দিতে পারে বিপত্তি।এ শীতে শিশুরা সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, জ্বর, নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়। শীতে আবহাওয়া শুষ্ক ও ধুলাবালি থাকার কারণেই মূলত শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত হয়। তাই এ সময়টা অভিভাবকদের কিছুটা সচেতন থাকতে হবে।
সচেতন হন
শিশুদের ঠাণ্ডা বাতাস এবং ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে। যেহেতু শীতে এ রোগগুলো সংক্রামিত হয় তাই যতটা সম্ভব শিশুদের জনসমাগমপূর্ণ জায়গায় কম নেয়াই ভালো। শিশুদের গামছা, রুমাল, তোয়ালে প্রভৃতি আলাদা হওয়া উচিত এবং আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সময় শিশুদের দূরে রাখা উচিত। শিশুদের স্কুলে অথবা বাইরে নিয়ে গেলে মুখে মাস্ক ব্যবহার করার অভ্যাস করাতে হবে। শিশুর এ ধরনের সমস্যায় আদা লেবু চা, গরম পানিতে গড়গড়া, মধু, তুলসি পাতার রস প্রভৃতি খাওয়ানো যেতে পারে। তবে সমস্যা বেশি হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
গরম পানি :শিশুদের হালকা কুসুম গরম পানি পান ও ব্যবহার করানো উচিত। সকালে ঘুম থেকে উঠার পর দাঁত ব্রাশ করা, হাত-মুখ ধোয়া, খাওয়াসহ শিশুদের নানা কাজে হালকা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করলে এ সময় শিশুরা ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকবে। শীতেও শিশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। তবে গোসলের সময় শরীরের কাছাকাছি তাপমাত্রার হালকা গরম পানি ব্যবহার করা ভালো। তবে নবজাতক কিংবা ঠাণ্ডার সমস্যা আছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে পুরো শরীর মুছে দেয়া যেতে পারে। অনেকেই শিশুকে জবজবে করে সরিষার তেল মাখিয়ে গোসল করিয়ে থাকেন। এতে গোসল শেষেও শিশুর চুল ভেজা থাকে এবং ঠাণ্ডা লাগে।
উষ্ণ পোশাক :শিশুদের অবশ্যই উলের পোশাক পরিয়ে রাখা উচিত। তবে চিকিৎসকের মতে শিশুদের সরাসরি উলের পোশাক পরানো ঠিক নয়। এতে উলের ক্ষুদ্র লোমে শিশুদের অ্যালার্জি হতে পারে। সুতি কাপড় পরিয়ে তার ওপর উলের পোশাক পরানো উচিত এবং পোশাকটি যেন নরম কাপড়ের হয়। কারণ খসখসে বা শক্ত কাপড়ে শিশুদের নরম ত্বকে সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে হালকা শীতে শিশুদের গরম পোশাকটি খুব বেশি গরম কাপড়ের হওয়া উচিত নয়। কারণ খুব বেশি গরম কাপড় পরালে গরমে ঘেমে শিশুর ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। শিশুদের রাতে ঘুমানোর আগে হালকা ফুল হাতা গেঞ্জি পরিয়ে রাখুন এবং সকালে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ও বিকালের দিকটাতে হালকা শীতের পোশাক পরিয়ে রাখুন।
খাবার :শীতের সময়টা শিশুদের খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। ফলে তাদের শরীর খারাপ হয়ে যায়। তাদের ঘনঘন পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। শিশুদের ত্বকের মসৃণতা ও উজ্জ্বলতা বাড়াতে ডিমের কুসুম, সবজির স্যুপ এবং ফলের রস খাওয়ানো উচিত। বিশেষ করে গাজর, বিট, টমেটো শিশুদের ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শীতের সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াতে পারেন। শিশুরা এ সময় যেন কোনো ধরনের ঠাণ্ডা খাবার না খায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
ত্বকের যত্ন :শিশুদের ত্বক বড়দের থেকে অনেক বেশি সেনসেটিভ। তাই তাদের ত্বক অনেক বেশি রুক্ষ হয়ে যায়। শিশুর মুখে এবং সারা শরীরে বেবি লোশন, বেবি অয়েল, গ্লিসারিন ইত্যাদি ব্যবহার করুন।
সংক্রমণের দিকে নজর রাখুন
শিশুদের শীতকালে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, এর মূলে যে বিষয়টি রয়েছে তা হল এই যে, তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতার মাত্রাটি থাকে কম।আপনি যদি আপনার বাচ্চার ঘুমের সময় তাকে জোরে জোরে শাঁ শাঁ শব্দের সাথে শ্বাস ফেলতে, মারাত্মক কাশতে লক্ষ্য করেন অথবা শ্বাসকষ্ট জনিত অসুবিধা হতে দেখেন, সেক্ষেত্রে সে হয়ত কোনও সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে, অবিলম্বে আপনার বাচ্চাকে তার চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। আর যদি এটি একটি সাধারণ সর্দি–কাশি হয় এবং অবস্থাটি খুব তীব্র না হয় তবে আপনি ঘরোয়া প্রতিকারগুলি বেছে নিতে পারেন। একটা সাধারণ সর্দি–কাশিও আপনার শিশুর ঘুমের ধরণকে ব্যাহত করতে পারে এবং তা পরের দিন তাকে ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই তাকে রাত্রে ঠিকমতো বিশ্রাম পেতে সহায়তা করার জন্য ভিক্স ভেপোরাব** (2 বছর বা তার বেশি বয়সী শিশুদের জন্য উপযুক্ত) দিয়ে তার গলা, বুক এবং পিঠের উপর একটা হালকা মালিশ করে তার গায়ে একটা হালকা কম্বল জড়িয়ে দিন। মেন্থল এবং ইউক্যালিপটাস তেলের প্রাকৃতিক গুণ আপনার শিশুকে কোনওরকম অসুবিধা ছাড়াই শ্বাস–প্রশ্বাস নিতে এবং কাশি থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করবে। ৩ মাস বা তারও বেশি বয়সী বাচ্চাদের জন্য আপনি ভিকস বেবিরাব * ব্যবহার করতে পারেন যা কোনও শিশুকে ময়েশ্চারাইজ, প্রশমিত ও শান্ত করতে সহায়তা করে।বেবিরাব এবং আপনার স্নেহের স্পর্শ যৌথভাবে আপনার শিশুকে ময়েশ্চারাইজ করবে আর এই বামের ল্যাভেন্ডার এবং রোজমেরির সুবাস তাকে শিথিল করতে এবং ঘুমাতে সহায়তা করবে।
পরিশেষে বলতে চাই, শীতকালে আপনার বাচ্চার যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে আপনাকে একটু অতিরিক্তই যত্নশীল হয়ে উঠতে হবে, আবার মাঝেমধ্যে অত্যধিক সতর্কতাও অবলম্বন করা প্রয়োজন। কিন্তু আপনার বাচ্চা যতক্ষণ উষ্ণ এবং নিরাপদে সুরক্ষিত থাকে, ততক্ষণ এসব কিছুই ঠিক আছে। শীতের সুন্দর দিনগুলিতে আপনার শিশুর ভালভাবে যত্ন নেওয়ার জন্য উপরে উল্লিখিত নির্দেশিকাটি অনুসরণ করুন আর আপনার বাচ্চা যদি এক–দু‘বার হাঁচিও দেয় অযথা আতঙ্কিত হবেন না।
লেখক : চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক।