সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : ভৈরবে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে একই গ্রামে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৫০ জন আহত ও ১০টি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে। আজ রবিবার সকাল ৯টায় উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের গোছামারা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এ তথ্য নিশ্চিত করেন ভৈরব থানা অফিসার ইনচার্জ মো. সফিকুল ইসলাম। আহতদের মধ্যে ২২ জন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেন। 

ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রুবেল, মহরম আলী, সফি উদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, মোস্তফা, সৌরভ আহমেদ, জীবন, জিলানী, ইবাদুল, জোবায়ের, সজীব সরকার ও সালাম প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। এছাড়া গুরুত্বর আহতদের মধ্যে জনি মিয়া, সফি উদ্দিন ও আমির হোসেনকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি রাখা হয়েছে। গুরুত্বর আহত রাশেদ মিয়া (৬৫) কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। অনেকে আবার ভৈরবের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

স্থানীয়রা জানান, গত ২ মাস আগে থেকে স্থানীয় সরকারের খাল খনন প্রকল্পের আওতায় উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নে গোছামারা কোদালকাটি খাল খননে ঠিকাদারী পান মমিনুল হক ট্রেডার্স এর মালিক সেলিম মিয়া। তিনি সময়ের আগেই নিয়ম না মেনে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করছে। এতে করে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় দফায় দফায় ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনে বাধা দেই। গত দুই মাসের ভিতর শিমুলকান্দি ইউনিয়নে বালু উত্তোলনের পক্ষে ও বিপক্ষে একাধিক গ্রুপিং এর সৃষ্টি ও মারামারি হয়। সিডিউল অনুযায়ী শুকনো মৌসুমে বালু উত্তোলনের কথা থাকলেও বর্ষাকালেই ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় শিমুলকান্দি ইউনিয়নের কৃষক ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাঝে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

স্থানীয়রা আরো জানান, বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করে স্থানীয় কৃষক ও সাধারণ মানুষ। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিনিধি এসে কৃষকদের আশ্বস্ত করে যান বালু উত্তোলন বন্ধ রাখবেন এবং কৃষকদের যেন কোন ক্ষতি না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখভেন। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মমিনুল হক ট্রেডার্স প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে দেদারচ্ছে বালু উত্তোলন করছে। গত ১৫ দিন আগে ভৈরব উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। নির্দেশ অমান্য করে বালু উত্তোলন করায় গত ১৬ নভেম্বর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. ইকবাল হোসেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান, বিজিবি সদস্য ও পুলিশ সদস্য সরেজমিনে শিমুলকান্দি ইউনিয়নসহ গোছামারা এলাকা পরিদর্শন করে। এতে করে নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের সত্যতা পেয়ে ড্রেজারে ফিটিং করা পাইপ খুলে ফেলে দেয় প্রশাসন। এ সময় স্থানীয়রা কিছু পাইপ ভেঙ্গে ফেলে। এতে করে সাবেক ইউপি সদস্য শাহজাহান মিয়া বাড়ি/ হানকি বাড়ি ও সাত ভাই বাড়ি / ছাগইল্লা বাড়ি লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আজ ১৯ নভেম্বর রোববার দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এতে ৫০ জন আহত হয়।

এদিকে খালপাড় এলাকার একাধিক লোকজন জানিয়েছেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান লোড ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় সাধারণ মানুষের ফসলি জমি আগামী বর্ষা মৌসুমে ব্যাপক ভাঙ্গন দেখা দিবে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান খাল খননের নাম করে লোড ড্রেজার দিয়ে খালের তল দেশ থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে অন্যত্র বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এক শ্রেণির অসাধু প্রভাবশালী লোকজন ঠিকাদারের টাকা খেয়ে সাধারণ মানুষদের উপর প্রতিদিন চড়াও হচ্ছে। কোদালকাটি খালপাড়ে জমি আছে এরকম সাধারণ মানুষ বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ করেও প্রতিকার পাইনি বলে অভিযোগ করছে। এই অবস্থায় কোদালকাটি খাল খনন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে এখানে কয়েকজন মারামারি করে খুন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শিমুলকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ভূইয়া রিপন বলেন, রোববার সকালে ড্রেজারের বালু উত্তোলনকারী লেবার সরাফত উল্লাহকে মারধোর করে শাহজাহান মিয়া মেম্বারের পক্ষের লোকজন। এ সময় কিছু পাইপও তারা ভেঙ্গে দেই। এতে করে সাবেক চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া পক্ষের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মীমাংসা করতে সময় নির্ধারণ করা থাকলেও এর ভিতরেই তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক লোক আহত হয়েছে।

শাহজাহান মিয়ার বাড়ির পক্ষে শাহজাহান মেম্বার বলেন, নিয়ম না মেনেই মমিনুল হক ট্রেডার্স নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। তারা সিডিউলে ট্রেন্ডার অনুযায়ী শুকনো মৌসুমে ৭০% কাজ ভেক্যু দিয়ে, ৩০% কাজ লেবার দিয়ে করাবে। তা না করে বর্ষা মৌসুম থেকেই তারা অবৈধভাবে লোড ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করে দিয়েছে। প্রশাসন তাদের বাধা অপেক্ষা করে বালি উত্তোলন করে যাচ্ছে। এতে আমাদের অনেক জমি ক্ষতি হচ্ছে। আমরা বাধা দিলে আমাদের উপর চড়াও হয়ে আক্রমণ করছে।

সাত ভাইয়ের বাড়ি ও ছাগইল্লা বাড়ির পক্ষে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া বলেন, সরকারি নির্দেশনা মেনে বালু উত্তোলন বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু একটি মহল ড্রেজারের শ্রমিককে মারধোর করে প্রায় শতাধিক পাইপ ভেঙ্গে দিয়েছে। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে গেলে এতে সংঘর্ষ বাধে।

ভৈরব থানা অফিসার ইনচার্জ মো. সফিকুল ইসলাম জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি। ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন নিয়েই দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়েছে। তবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল এই বিবাদ তৈরি করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে দুই পক্ষের ৪ জন করে ৮ জনের মোছলেখা নেয়া হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(এসএস/এসপি/নভেম্বর ১৯, ২০২৩)