মাদারীপুর প্রতিনিধি : মাদারীপুর জেলা বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীণ ও সমৃদ্ধ জনপদ। এ জেলার রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনসহ ১৯৭১ খ্রি. এর মহান মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর জেলার রয়েছে অসামান্য গৌরোবজ্জ্বোল অবদান। অত্যন্ত প্রাচীণ ও ইতিহাস সমৃদ্ধ অঞ্চল হলেও মাদারীপুর জেলা বা এর সন্নিকটবর্তী অঞ্চলে এই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই।

ফলশ্রুতিতে সময়ের পরিক্রমায় অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন, ঘটনাবলী ও দৃষ্টান্ত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে এবং প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অনাগত প্রজন্মকে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেই ইতিহাস সংরক্ষণ করতে জাদুঘর হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যমগুলোর একটি।

সামগ্রিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসন, মাদারীপুর ‘মাদারীপুর মিউজিয়াম’ নামে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ৩১ মার্চ, ২০২৩ তারিখে শাজাহান খান, এম.পি, সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে মাদারীপুর মিউজিয়াম উদ্বোধন করেন। এ সময় মাদারীপুর জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বীরমুক্তিযোদ্ধাগণসহ বিভিন্ন দপ্তরের দপ্তর প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন।

জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন ঐতিহাসিক পুরাতন ট্রেজারি ভবনকে জাদুঘরে রুপান্তর করা হয়েছে। ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধে এ ভবনের রয়েছে অনন্য ঐতিহাসিক অবদান। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো মাদারীপুর জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়। যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতিগ্রহণের উদ্দেশ্যে মাদারীপুর জেলায় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

বেনজীর আহমেদ টিপু তার ‘মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর’ বইয়ের ১৬২-১৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখেন, “২৭ মার্চ থেকেই মাদারীপুর শহরে ছাত্র-যুবকদের নিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি। প্রশিক্ষণের জন্য বিমান বাহিনীর সদস্য আলমগীর হোসাইন ও মতিয়ার রহমান হাওলাদার, সেনাবাহিনীর সুবেদার আব্দুল হকের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ থাকলেও প্রশিক্ষণের জন্য কোন অস্ত্র ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত। তিনি নিজে দাড়িয়ে থেকে মাদারীপুর ট্রেজারিতে রক্ষিত থ্রিনটথ্রি রাইফেলগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ প্রতিদিন ট্রেজারি থেকে অস্ত্র নিয়ে যেতেন ও প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় ট্রেজারিতে অস্ত্র জমা রেখে যেতেন। এই উদ্যোগের ফলে মাদারীপুর জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সুসংগঠিতরুপে গড়ে উঠে। জনসাধারণের মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। অচিরেই মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত ও মহকুমা ট্রেজারি ভবন মাদারীপুর জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। মাদারীপুর জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল ট্রেজারি ভবনে রক্ষিত রাইফেল দিয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ভবনটির রয়েছে অসামান্য অবদান।”

পরবর্তীতে ১৯৯২ খ্রি. তারিখে মাদারীপুর জেলা কালেক্টরেট পূর্বের শকুনী লেকপাড় হতে স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলশ্রæতিতে জেলা ট্রেজারি নতুন কালেক্টরেট ভবনে স্থানান্তরিত হয়। কালক্রমে পুরাতন ট্রেজারি ভবন ব্যবহার অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত ভবনে রূপান্তরিত হয়। এই ভবনটির অবস্থান মাদারীপুর শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে, দৃষ্টিনন্দন শকুনী লেক পাড়ে। ভবনটির অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হওয়ায় এ ভবন ও জমির উপর স্থানীয় দুর্বৃত্তচক্রের লোলুপদৃষ্টি পড়ে। নাম সর্বস্ব সংগঠনের নামে পুরাতন ট্রেজারী ভবন ও জমির একাংশ বেদখল হয়ে যায় যা জাদুঘর স্থাপনের পর দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

এ বিষয়ে মাদারীপুর জেলার জেলা প্রশাসক ও মাদারীপুর মিউজিয়াম এর সভাপতি মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, “জেলা প্রশাসন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘর মাদারীপুর জেলাসহ বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এ জাদুঘর মাদারীপুর জেলার নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী, মাদারীপুরের কৃতি সন্তান কাজী আনোয়ার হোসেন এর প্রায়শতাধিক দুর্লভ চিত্রকর্ম মাদারীপুর মিউজিয়ামের অনুকুলে উপহার হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছে। জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য মাদারীপুর জেলার জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সচেতন নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মাদারীপুর মিউজিয়াম এর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন করা হয়েছে। ট্রাস্টি সদস্য হিসেবে মাদারীপুর জেলার প্রথিতযশা কৃতিব্যক্তিবর্গকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ জাদুঘর জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে অগ্রগণ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

মাদারীপুর মিউজিয়াম এর কিউরেটর ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, “জাদুঘরটিকে বর্তমান অবস্থানে আনতে জেলা প্রশাসনকে বিশাল কর্মজজ্ঞ বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। পুরাতন ট্রেজারী ভবনের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে ভবনটিকে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। পুরাতন ট্রেজারী ভবন ব্যবহার অনুপযোগী থাকায় ভবনটিকে সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। রাতের বেলায় জায়গাটিতে মাদকসেবীদের আড্ডা বসতো বিধায় তা বন্ধ করা হয়েছে। নিরাপত্তা দেওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদানসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে জাদুঘরটি রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। এই জাদুঘরে যে কোন দর্শনার্থীর জন্য প্রবেশ ফি সম্পূর্ণ ফ্রি।”

(এএসএ/এএস/জানুয়ারি ২৪, ২০২৪)