অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ : গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি। আর দিনে দিনে এই কৃষিখাতে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তেমনি ড্রাগন চাষে অভিনব এক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফল হয়েছেন এক উদ্যোক্তা। তাঁর এই প্রযুক্তি ড্রাগন চাষে এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। দেশে এমন পদ্ধতি সত্যিই দেখা মেলা ভার। অভিনব লাইট ইনডোর্স পদ্ধতি ব্যবহারে একদিকে যেমন অপরুপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে ফলন বৃদ্ধি করেছে প্রায় ৩ গুণ। আবার অসময়ে ড্রাগণ উৎপাদন করে দেশের মধ্যে সাড়া ফেলেছেন এই উদ্যোক্তা। বলছিলাম ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চারাতলা গ্রামের বিপ্লব জাহানের ড্রাগন বাগানের কথা। এমন ব্যতিক্রম উৎপাদন পদ্ধতি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই আসছে শত শত দর্শনার্থীরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, সারি সারি লাইট আর নিচে সবুজ ড্রাগন গাছ ও উপরে সাদা ফুলের হাতছানি। দেখে মনে হবে আঁধার রাতে আলো আর সবুজ-সাদার মিলনমেলা। প্রতিটা ড্রাগন গাছের মাথার উপর একটি করে লাইট জ্বালানো। প্রতিটি গাছেই ফল ধরে আছে আবার ফুলও ফুটতে শুরু করেছে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে লাইটগুলো জ্বলার পর তা অপরুপ সৌন্দর্যে রুপ নেয়। এমন ভিন্নতা দেখতে প্রতিদিন জড়ো হচ্ছে শত শত মানুষ। বৈচিত্রময় চোখধাধানো আলোকসজ্জায় গা ভাসাতে বিভিন্ন জেলা থেকেও আসছে দর্শনার্থী।

জানা গেছে, প্রায় ৩ বছর আগে উপজেলার চারাতলা গ্রামে ১১ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয় এই ড্রাগন বাগান। এখানে ৩০ হাজার গাছে প্রতি বছরে ফলন হতো গড়ে ৪৫ টন। বাগানটিতে মাসে খরচ ২ লাখ টাকা। প্রতিদিন ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করেন। দেড় মাস আগে চীন থেকে ৩ হাজার ৩০০ বিশেষ ধরনের লাইট এনে রাতে লাইট ইনডোর্স পদ্ধতিতে শুরু হয়েছে ড্রাগন ফলের পরিচর্যা। যা অসময়ে স্বাস্থ্য সম্মত ড্রাগন ফল উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আলোর কারণে বাগানে ফুলের সংখ্যা গত মৌসুমের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখন প্রায় ৭০ হাজার ফুল ফুটেছে। যা অন্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।

কোটচাঁদপুর থেকে বাগান দেখতে আসা কৃষক রিপন মণ্ডল বলেন, তিনি ড্রাগন বাগান করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। এজন্য বিভিন্ন বাগান পরিদর্শন করেছেন। সাধারণ ড্রাগন চাষ পদ্ধতির থেকে আল্ট্রা হাইড্রেনসিটি পদ্ধতি অনেক ভালো ছিল, তবে এই আলো জ্বালিয়ে যে পদ্ধতিতে ড্রাগন চাষ করা হচ্ছে তা অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু অন্য পদ্ধতিগুলো থেকে এই পদ্ধতিতে খরচ বেশি হলেও এতে অসময়ে যেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে, আবার দামটাও অন্য সিজনের তুলনাই বেশি পাওয়া যাচ্ছে। অল্প করে হলেও এই পদ্ধতিতে চাষ করা ভালো। দর্শনার্থী বিজয় ভৌমিক বলেন, ড্রাগন বাগানে আসার পর দেখতে অনেক ভালো লাগলো। এমন সৌন্দর্য সত্যিই আগে দেখিনি। বন্ধুদের থেকে শোনার পর এসেছি, দেখে অভিভূত। এই বাগানকে ঘিরে এই জায়গাতে আরো উন্নত হবে বলে মনে করেন তিনি।

বাগানের কর্মচারী মনিরুল ইসলাম বলেন,যে সময় ড্রাগনের কোন চাষ থাকে না সেই অসময়ে এমন উৎপাদন সত্যিই অভিনব ঘটনা। এর আগে কখনো এমন বাগানে কাজ করেননি। এই বাগানে নিয়মিত ১৫ জন কাজ করে। রাতে একজন নাইট গার্ড বাগান পাহারা দেয়। যখন ফুল ফোটে তখন রাতেও ফুলগুলো কৃত্রিম পরাগাইনের জন্য কাজ করতে হয়। ড্রাগণ ফ্রুটস এণ্ড এগ্রোর স্বত্বাধিকারী বিপ্লব জাহান জানান, ইউটিউব দেখে মুলত এ পদ্ধতির খবর জেনেছিলাম। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাপক ফলন পাচ্ছি। প্রাথমিকভাবে বড় অংকের টাকা লাগলেও লাভও হয় ৩ গুণ। সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা ও রাত ৩টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত মোট ৯ঘন্টায় দুইদফা লাইটগুলো জ্বলে। শীতকালে দিন ছোট হয় তাই দিনের আলো কম হয়। ড্রাগণ বেড়ে ওঠে মুলত দিনের আলোয়, তাই এ পদ্ধতিতে চাষ করলে রাতেও ড্রাগনের সঠিক বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক থাকে।

তিনি আরো জানান, এই বাগানে ৩৩ হাজার ড্রাগনের গাছ রয়েছে। যা থেকে তিনি গতবছর বিক্রি করেছেন ৩০ লাখ টাকার ড্রাগন। দেশের কোথাও এখন ড্রাগন ফলের উৎপাদান না থাকলেও তার বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে ড্রাগন ফল। যা নিয়মিত ৩৫০টাকা কেজি দরে বিক্রিও হচ্ছে। এ বছর ৫০ হাজার মেট্রিকটন ড্রাগন উৎপাদন হবে বলে তিনি জানান।

(একে/এএস/ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২৪)