শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : নিউ রাজা,রাস্তার পাগলা, পঙ্খীরাজ, পাগলা রাজা, রংবাজ, পারলে ঠেকাও, কাজলি, তাজিয়া, বিজলী রানী, বাহাদুর, শক্তিমান এমন বাহারি সব নামের ঘোড়ায় জমজমাট এখন দিনাজপুরের চেরাডাঙ্গী মেলায়। এসব ঘোড়ার ক্ষিপ্রতা আর বুদ্ধিমত্তায়ও মেলে নামের সার্থকতা।ঘোড়াগুলোর দুলকী চলনে বিদ্যুৎগতি, চোখের পলকে যেন মাইল পার- এমন নানামুখী গুণের কারণে কদরও যথেষ্ট। পছন্দের ঘোড়া পেতে ক্রেতাদের মধ্যেও চলছে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। মেলায় বিক্রির জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিজেদের পোষা ঘোড়া নিয়ে এসেছেন ঘোড়া ব্যবসায়ীরা।

মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ২৩ মাঘ উদ্বোধন হয় এই মেলার। মূল মেলা এক মাস হলেও পশুর মেলা চলে ১৫ দিন। এরমধ্যে প্রথম এক সপ্তাহজুড়ে চলে ঘোড়ার হাট। শুরুর দুই-তিন দিন পর মহিষ, গরু, ভেড়া ও ছাগল কেনাবেচাও চলে এ মেলায়।ঘোড়ার উপস্থিতি চোখে ধরার মত।

এছাড়া বিনোদনের জন্য যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ এবং সংসারের যাবতীয় আসবাবপত্র কাঠ, স্টিল ও প্লাস্টিকের ফার্নিচার, মিষ্টান্ন, মসলা, জুতা ও কাপড়.প্রসাধনিসহ এমন কোনো জিনিস নেই যা এ মেলায় বিক্রি হয় না।

ক্রেতা-বিক্রেতা ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় এখন মুখর ঐতিহ্যবাহী চেরাডাঙ্গী মেলার ঘোড়ার হাট। ঘোড়ার হাটটি এখন ঘোড় সওয়ারি ও ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় মুখরিত-জমজমাট। দরদাম ঠিক করার পর একটি খেলার মাঠে ক্রেতাকে দেখানো হয় ঘোড়ার দৌড়। সগৌরবে ক্ষিপ্রতায় ছুঁটে চলা ঘোড়ার তেজদীপ্ততায় তৃপ্ত হয় ক্রেতার মন, দর্শনার্থীর চোখ। কোলাহলে মুখরিত হয় পুরো হাট এলাকা।
নওগাঁ ধামইরহাট উপজেলা থেকে এসেছেন সামছুল আলম। তার ঘোড়া অত্যন্ত প্রখর। দ্রুত গতিতে ছুঁটে। এজন্য ঘোড়ার নাম দিয়েছেন ‘পারলে ঠেকাও’। এলাকায় তার ঘোড়াকে সবাই ‘পারলে ঠেকাও’ বলেই ডাকে। তার ঘোড়ার দাম এক লাখ টাকা। ৮০ হাজার টাকা হলে ঘোড়াটি ছেড়ে দিবেন বলে জানালেন তিনি।

নওগাঁ সাপাহার থেকে ৫টি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন মোঃ মোস্তাক। তার ঘোড়ার নাম নিউ রাজা। তিনি অপকটে জানালেন,তার ঘোড়া নতুন রেসের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।তাই তার নাম দিয়েছেন নিউ রাজা। কিন্তু তার ঘোড়ার কাংখিত দাম নেই বলে জানালেন তিনি।

দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার হাটখোলা থেকে নজরুল আলম নজু এসেছেন দুইটি ঘোড়া নিয়ে। তাকে সবাই ঘোড়া নজু বলে চেনেন। তিনি গত বছর যে ঘোড়া নিয়ে এসেছিলেন.সেই দুই’টির নাম ছিলো ‘কিরণ মালা’ ও নাগমনি। দু’টোই ছিলো মহিলা ঘোড়া। এবারের দু’টো পুরুষ ঘোড়ার নাম ’সাদাবাজ’ এবং ’চিল’। দাম হাকিয়েছে, আকটি ৭০ হাজার আরেকটি ৬০ হাজার। গতবার ‘কিরণ মালা’ বিক্রি করেছেন ৮০ হাজার টাকায়।

গাইবান্ধার সাদুল্লাহপুর থেকে এসেছেন রমজান আলী। রাজা ও রাস্তার পাগল নামের দুইটি ঘোড়া নিয়ে এসেছেন তিনি। তার ঘোড়াগুলো দ্রুতগতি সম্পন্ন বলে তিনি জানালেন। একেকটি ঘোড়ার দাম হাঁকছেন লাখ টাকা। ক্রেতা আসছেন, দেখছেন, দাম বলছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ায় তিনি এখনও ঘোড়াগুলো বিক্রি করছেন না।

‘কুমার রাজা’ নামের লাখ টাকা মূল্যের একটি ঘোড়া বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন নীলফামারীর জলঢাকার মোসাদ্দেক আলী। গ্রায় ২৬ বছর এ ব্যবসার সঙ্গে তিনি জড়িত। তার ঘোড়াগুলো খুবই বিশ্বস্ত বলেও তিনি জানালেন।

দিনাজপুর চিরিরবন্দরের শান্তির বাজার থেকে ঘোড়া নিয়ে মেলায় এসেছেন মো. নূর ইসলাম। তিনি জানালেন, গত বছর এনেছিলাম কিরণ মালা। এবার মেলায় এনেছি পুরুষ ঘোড়া ’রংবাজ’। ৮০ হাজার টাকা রেখেছেন রংবাজের দাম। তা বিক্রি করে এই মেলা থেকেই আরো একটি নতুন ঘোড়া কিনবেন।
চেরাডাঙ্গী মেলা কমিটির সভাপতি মিজানুর রহমান মিজান জানালেন, ’১৯৪৮ সাল থেকে এ মেলা শুরু। প্রায় শত বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী এ মেলা শুরু থেকেই ঘোড়ার জন্য প্রসিদ্ধ। স্বাধীনতার আগে এ মেলায় নেপাল, ভুটান, ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলো থেকে উন্নত জাতের ঘোড়া আসতো। এত বড় ঘোড়ার মেলা উত্তরবঙ্গের কোথাও নেই। নানা আকৃতি ও হরেক রঙের ঘোড়ার দেখা মিলবে এ মেলায়। প্রায় আড়াই কিলোমিটার বর্গাকার এ মেলা ঘিরে এলাকার ২৩ গ্রামে চলে মেজবান আয়োজনও।’

স্থানীয় আউলিয়াপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এই মেলা জানালেন, ঐতিহ্যবাহী এ পুরনো মেলা আর কোথাও নেই। কালের বিবর্তনে আগের চেয়ে মেলার অবয়ব ছোট হলেও এখনও এই মেলার কারণে এলাকার আশপাশের গ্রামগুলোতে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। আত্মীয়-স্বজনেরা বেড়াতে আসে। উৎসব চলে মাসব্যাপী ঘরে ঘরে।’

দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার মো. ফরিদ হোসেন জানান, মেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মেলায় বিশেষ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। মেলায় আগত বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী, ক্রেতা-বিক্রেতার নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশের।

(এসএএস/এসপি/ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০২৪)