পীযূষ সিকদার


গান আমার প্রিয় বিষয়। ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে মেতে রইলাম গানে গানে। তাও আবার বাউল গানে। যেখানে শিল্পীরা পরিবেশন করে একের পর এক ভাব সঙ্গীত। সুরের মুর্চ্ছনা ও লালনগীতির অধ্যাত্ম চেতনায় আমি বিমোহিত হই। বিমোহিত হই চেতন গুরুর সান্নিধ্য লাভে। সে শুধু আমিই জানি। এত বোঝাবার নয়। বোঝাবার গেলেই যে প্রসঙ্গ আসবে আমার মতো দীনহীনের সাধ্য কী সে কথা বলবার! প্রথম দিনে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে বাংলার প্রান্তিক বাউল শিল্পীগোষ্ঠীর অনুষ্ঠান শুরু হয়। তারপরই বাউল নিজাম সাঁইজির লালন ফকিরের অধ্যাত্ম চেতনার গান “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।” গান দিয়ে শুরু করা হয় প্রান্তিক বাউল উৎসব-২০২৪। আযানের সুমধুর সুরকে তো আর উপেক্ষা করা চলে না। তাই অপরদিকে চেয়ে রইলাম কর্ণপথে শুনতে লাগলাম আযান। তারপর বাউলের ভাব নিয়ে কথা বললেন আমার অগ্রজ কবি জাহাঙ্গীর খান।

দ্বিতীয় দিনে প্রান্তিক বাউল উৎসব-২০২৪ অনুষ্ঠান শুরু হলো একটু দেরী করেই। তারপরও তো গানতো আমাকে নিরোগ করে। একটু খারাপ লাগলেও শিল্পীদেরকে তো আর অবহেলা করা যায় না। বাউলের গানে আছে দর্শন। যদিও সবারই দর্শন আছে। বাংলা খেটে খাওয়া মানুষেরও দর্শন আছে। সেই দর্শনকে তো বাদ দিয়ে আমি না। সবাইকে নিয়েইতো আমাদের পথচলা। সবরাই স্ব স্ব দর্শন আছে। তাদের (অন্তজ) কথা বাদ দিয়েতো আর ভাবের কথা বলা যায় না। বাউলরা নিরিবিলিতেই থাকেন। কারণ তিনি একেশ্বরীকে নিজের মধ্যে ধারণ করে মুক্তি খুঁজছেন। কিসের মুক্তি। কার মুক্তি। এই ভাবনাটা ক্ষুদ্র আমার কাছে নড়বড়ে ঠেকে!

প্রশ্ন জাগে মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি। যেহেতু বাউলের প্রধান বিষয়ই মানুষ। মানুষ তুলে ধরো মানুষ তত্ত্ব করো। আসলে তত্ত্ব কী? ফিলোসফি আগে না তত্ত্ব আগে? এই প্রশ্ন গুলো তোলা রইলো এই দীনহীন কলম লেখকের। আসলে বহুর মধ্যে এক হবার শিক্ষাটাকে দিয়ে গেছেন লালন। তাইতো তাঁর গানে বাণীতে চেতনগুরুর কথা বলা হয়েছে। চেতনগুরু সেই যে দুইয়ে মিলে এক হয়। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন নিষ্ঠার সাথে তিনি মনজুর তারেক। দ্বিতীয় দিনে বক্তব্য রাখেন আমার পূজ্যপাদ ড. বিপ্লব বালা। তিনি বলেন, বাউলেরা আড়ালে লোকচক্ষুর বাইরে থাকেন। সেই প্রান্তিক বাউল যে কোনাকানছিতে থাকেন। তাই তাদের ভাবজগৎ আলাদা। অন্যরকম। আরো বলেন, প্রান্তিক বাউল যারা তারা কেন্দ্রের বাইরে থাকেন। কেন্দ্র হচ্ছে ক্ষমতা। আবার বলেন অন্যরকম মানুষ। মানে সাধারণের বাইরে থাকে। উনি স্পষ্ট উচ্চারণে বাউলের দর্শন বলে গেছেন। মনের ভিতরে যে দুইয়ের বসবাস এক হবার বাসনাই তো বাউল চেতনা। তিনি নিজের চৈতন্যের কথা বলেছেন। বলেছেন অদ্বৈত হবার। বহুর মধ্যে এক হবার অখন্ড হবার কথা বলেছেন। তিনি যে কেন্দ্রের কথা বলেছেন সেটা রাজনীতি। রাজনীতি যদিও সবখানে। সাধুরা এখানে নিরব। যাই হোক, সাধুরা যে মিলবার এবং মিলানোর কথা বলেছেন। চেতন থেকে চৈতন্যে।

মেলা ভাঙলো। মিলন মেলা ভাঙলো। ফরিদপুর ও ফরিদপুরের অনেক শিল্পী এসেছিল। অনেক শিল্পীই তাদের বাউলগান নিয়ে এসেছিলো। বাউল সাইফুল ইসলাম, মামুন শাহ, আউয়াল বাউল, কুদ্দুস বাউল, বাউল বাবুল খান, নিজাম সাঁই প্রমুখ। যন্ত্রীদল- আমি নির্বাক। চলুক না। সাধুসঙ্গ। এ যেনো মিলবার এবং মিলানোর এক মহামিলন।

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।