অরিত্র কুণ্ডু, ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। লোভে পড়ে শিক্ষার্থী ও তরুণেরা এই জুয়ায় বেশি আসক্ত হচ্ছেন। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে তাঁদের অনেকে। এ কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ।

জানা গেছে, জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোয় এই জুয়া বিস্তার লাভ করছে। সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য মানুষ এই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। তরুণদের অনেকেই কৌতূহলবশত এই খেলা শুরুর পরেই নেশায় পড়ে যাচ্ছেন। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময় খোয়াচ্ছেন হাজার হাজার টাকা।

অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্মার্টফোনে নির্ধারিত কয়েকটি অ্যাপস ডাউনলোড করে সেখানে জুয়া খেলা চলে। বিভিন্ন নামের প্রায় ১০ থেকে ১২টির মতো অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়।

জুয়ায় জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, এসব অ্যাপসের বেশির ভাগই পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাংলাদেশে এগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি (এজেন্ট) থাকে। জেলায় এ ধরনের শতাধিক এজেন্ট রয়েছে।

তাঁরা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ বা প্রদান করে থাকে। এজেন্টরা বিদেশি অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে হাজারে অন্তত ৪০ টাকা কমিশন পায়। এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে টাকা পাচার হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কলেজ শিক্ষার্থী বলেন, প্রথমে ৫৬ টাকা বিনিয়োগ করে ১৬ হাজার টাকা পান তিনি। এতে লোভে পড়ে এই খেলায় মারাত্মক আসক্তি চলে আসে তাঁর। গত ছয় মাসে এই জুয়ার নেশায় পড়ে মোটরসাইকেল বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এমনকি শেষ বর্ষের পরীক্ষার মধ্যেও তিনি খেলা ছাড়তে পারেননি।

অনলাইন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, এসব খেলা স্বাভাবিক গেমের মতো হওয়ায় প্রকাশ্যে খেলা হলেও আশপাশের মানুষ তা বুঝতে পারেন না। জুয়ায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বেশির ভাগেরই স্মার্টফোন রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম অংশগ্রহণকারীদের জুয়ায় জিতিয়ে লোভে ফেলা হয়। এরপর নেশা ধরে গেলে একের পর এক টাকা খোয়ানোর ঘটনা ঘটতে থাকে। তখন আর বের হওয়ার পথ থাকে না।

শৈলকূপার এক শিক্ষার্থী জানায়, বন্ধুদের জুয়া খেলতে দেখে প্রাইভেট পড়ার ১৫০০ টাকা শিক্ষককে না দিয়ে তা দিয়ে খেলা শুরু করেছিল সে। শুরুর দিকে ভালো লাভ হতে থাকে। কিন্তু তার পরেই লোকসানের পাল্লা ভারি হতে থাকে। ইতিমধ্যেই বাড়ি থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা নিয়ে খেলায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত মোবাইল বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাকে। এটি নেশার মতো। খেলা শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ খেলতে ইচ্ছা করে।

কালীগঞ্জের আড়পাড়া এলাকার এক নারী বলেন, তাঁর স্বামী অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কলহ দেখা দেওয়ার একপর্যায়ে পারিবারিকভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের।

এ ব্যাপারে ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার আজিম-উল-আহসান জানান, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা বদলে যেতে শুরু করেছে। সেইসঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন অপরাধ বাড়ছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এই ধরণের অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে।

(একে/এএস/ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৪)