সোহেল সাশ্রু, কিশোরগঞ্জ : ভৈরবে বেড়েছে চুরি ও ছিনতাই। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে এ ঘটনা। চোর ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্যে নির্বাক প্রশাসন। অভিযোগ ছাড়া কোন রকম অ্যাকশনে যাওয়া যাচ্ছে। যাদেরকে আটক করা হচ্ছে তারা দুই তিনদিনের মধ্যে জামিনে বের হয়ে আসছে এমনটাই দাবী করছেন ভৈরব থানা অফিসার ইনচার্জ মো. সফিকুল ইসলাম।

এ দিকে প্রতিদিন কোন না কোন চুরি ছিনতাইয়ের ঘটনার শিকার হচ্ছে ভৈরবের সাধারণ মানুষ ও ভৈরব আসা পার্শ্ববর্তী উপজেলার মানুষগুলো। এতে বাদ যাচ্ছে না বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, রাজনিতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ।

আগে রাতের আধারে চুরি ও ছিনতাই হলেও এখন দিনে দুপুরে ঘটছে চুরি ও ছিনতাইয়ের মত ঘটনা। ঘটনাগুলো ঘটছে দুই চারটা চিহ্নিত জায়গায় যা ভৈরবের প্রশাসনসহ সবারই জানা। কারা এ ঘটনার গুলোর সাথে জড়িত তা করোরই জানার বাকি নেই। এদের মধ্যে ভৈরব মেঘনা ব্রীজ সংলগ্ন নাটাল মোড় এলাকা, ব্রীজের নিচে রেলওয়ে স্কুল পিছন এলাকা, ভৈরবপুর উত্তর পাড়া পাওয়ার হাউজ এলাকা, রেলওয়ে স্টেশন রোডের কবরস্থান, পলাশ সিনেমা হলের মোড়, শহরের বঙ্গবন্ধু সরণির নদী বাংলা সেন্টার পয়েন্টের সামনে, গালস স্কুলের সামনে, রাষ্ট্রপতির বাড়ির সামনে, ভিআইপির সামনে, সরকারি কেবি স্কুলের সামনে, নিউটাউন এলাকা, নদীর পাড় এলাকা, কালিপুর পলতাকান্দা ব্রীজের উপরে, ভৈরব-কিশোরগঞ্জ আঞ্চলিক সড়কের পাক্কার মাথা কবরস্থান, পানাউল্লারচর ভূষির মিল, কালিকাপ্রসাদের গাজিরটেক এলাকায় ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।

গত ১৫ দিনে ভৈরবে ৪০টির মতো চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। থানায় গিয়ে মৌখিক অভিযোগ দিলেও পুলিশি হয়রানির জন্য কেউই মামলা করতে চান না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।

১৪ ফেব্রæয়ারি বুধবার রাত সাড়ে ৮টায় ভৈরব শহরের বাগান বাড়ি এলাকা থেকে ছিনতাইকারীরা অসহায় গরীব রিকশা চালকের কাছ থেকে ২৮০ টাকা ও ওই এলাকার ৩ লেবারের কাছ থেকে সারা দিনের পাওয়া মজুরী থেকে ২০০ টাকা করে ছিনতাইকারীরা নিয়ে যায়।

এছাড়াও ১ ফেব্রæয়ারি দুপুর দেড়টার দিকে আরিফ হোসেন নামের এক যুবককে ছিনতাইকারীরা নিউটাউন রেললাইনের উপরে গতিরোধ করে মারধর করে আহত করে। এ সময় তারা তার কাছে থাকা টাকা ও একটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে একজন ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় জনতা।

গত ২ ফেব্রুয়ারি ভৈরব শহরের নাটাল মোড় এলাকায় এক ব্যক্তিতে আক্রমণ করে প্রথমে ছুরিকাঘাত করে পরে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করে।

একই জায়গা থেকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি তিন কলেজ ছাত্রীকে আটকিয়ে ব্যাগ টাকাসহ সব কিছু ছিনিয়ে নেয়। এসময় স্থানীয়রা প্রতিবাদ করতে গেলে ছিনতাইকারীরা তাদের ছুরিকাঘাত করতে চেষ্টা করে।

১৩ ফ্রেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৬টায় দুই মহিলাকে একদল ছিনতাইকারী ছুরিকাঘাত করে স্বর্ণালংকারসহ সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি আরমান মিয়া নামে এক নিরীহ অটো চালকের অটো ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।

১৮ জানুয়ারি পৌর যুবলীগ সিনিয়র সহ-সভাপতি জিল্লুর রহমানকে রাত ৩টায় ভৈরব পাওয়ার হাউজের সামনে আটকিয়ে একদল ছিনতাইকারী মোবাইল ও সাথে থাকা তার ভাগ্নীর ব্যাগ ও মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, আমি থানায় অভিযোগ দিয়েছি। ছিনতাইকারীরা আমাদের চিনতে পেরেছিল তাই আঘাত করেনি। আমরা অসহায় হয়ে গেছি ছিনতাই চক্রের কাছে। ছিনতাইকারীরা ভৈরবের পরিচিত মুখ।

এ বিষয়ে পৌর ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী সোহাগ বলেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি আমার বাড়ি থেকে একটি সাইকেল চুরি করে নিয়ে গেছে চোর চক্রের সদস্যরা। সিসি ক্যামেরা থাকলেও তাদের সনাক্ত করা যাচ্ছে না।

পৌর ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মনির হোসেন জানান, ১৩ ফেব্রুয়ারি আমার বাড়ি থেকে টিউবওয়েল কেটে নিয়ে গেছে চোরের দলেরা। তিনি আরো জানান, সকালে ঘুম থেকে ওঠেই প্রতিদিন কোনো কোনো ছিনতাই ও চুরির অভিযোগ পাচ্ছি। বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসায়ও ঘটছে চুরির ঘটনা। আমরা নিরুপায়। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

১৩ ফেব্রæয়ারি চুরি ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা থেকে ভৈরবের ঐতিহ্যবাহী নৈশ মৎস আড়ত বাঁচাতে ৩২টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।
অপর দিকে ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সভা সেমিনার ও মানববন্ধন করেছে ভৈরবের সাধারণ মানুষ। গত ৯ ফেব্রæয়ারি বিকালে মানবন্ধন করেন আমজনতা নামের ব্যানারে বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

এ বিষয়ে স্থানীয়রা বলেন, আমাদের শহরে আমরা নিরাপদ নয়। ভৈরব শহরের বিভিন্ন জায়গায় সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। তবু আমরা নিরাপদ নয়। তবে ভৈরবে বেশ কিছু জায়গায় সিসি ক্যামরা বিকল হয়ে পড়ে আছে। ভৈরব প্রশাসনের গাফিলতির কারণে তা মেরামত করছে না। আগের রাতে চলাচলে ভয় পেলেও এখন দিনের বেলায় নিরব জায়গা দিয়ে চলাফেরা করতে ভয় পায়। ভৈরব প্রশাসনসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সুদৃষ্টি কামনা করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

এ বিষয়ে আমজনতার পক্ষে সোহাইল খান বলেন, ছিনতাই নিরসনে প্রশাসন তথা যথাযথ কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নীরবতার প্রতি অনাস্থায় প্রতিবাদ জানিয়ে মানবন্ধন করেছি। ভৈরবের মানুষ জবাবদিহিতা চায়, কেন নিজের শহরে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে না? মানুষ যদি প্রতিকার না পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর স্মারকলিপি দেয়, মানহানি কার হবে? অথবা যদি মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয় এর দায় কার উপর বর্তাবে?

ছিনতাইকারীদের আশ্রয় প্রশ্রয় যারা দেয় তাদের চেয়ে ভুক্তভোগীর সংখ্যা বেশি। তিনি জানান, ইতিমধ্যে ভৈরব থেকে ছিনতাই প্রতিরোধে একটি লিখিত স্মারক দেয়া হয়েছে ভৈরব থানা পুলিশকে।

এ ব্যাপারে সচেতন মহলের একজন ব্যক্তির সাথে কথা হলে তিনি বলেন, পুলিশকে জানিয়ে বা মামলা করলে কি হয়, তা আমার জানা নেই। আমার বাসার বিদ্যুতের তার, গ্যাসের রাইজার ও মোবাইল চুরির থানা দুটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু অভিযোগগুলি অদ্যাবধি পর্যন্ত থানা পুলিশ আমলে নেয়নি।

এ বিষয়ে ভৈরব পৌর মেয়র আলহাজ্ব মো. ইফতেখার হোসেন বেনু বলেন, ভৈরবে চুরি ও ছিনতাই ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছে। ভৈরব ছিনতাইয়ের প্রধান কারণ মাদক। ভৈরব মাদকের একটি টানজিট পয়েন্ট। মাদক নির্মুল করতে না পারলে চুরি ছিনতাই দিন দিন বাড়বেই। চুরি ছিনতাইয়ের অভিযোগে অতিষ্ট হয়ে পড়েছি। ভৈরব পৌর শহর সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলা ও থানা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রাখা ভৈরবের অনেক জায়গায় সিসি ক্যামেরা বিকল হয়ে পড়ে আছে যা দুঃখজনক। ভৈরব পুলিশের বিশেষ নজরদারি প্রয়োজন। ছিনতাইয়ের চিহ্নিত স্থান গুলোতে অধিক সিসি ক্যামেরা ও পুলিশের নজরদারি বাড়াতে হবে।

এ বিষয়ে ভৈরব থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগীদের মৌখিক অভিযোগ পায় তবে বেশিরভাগ মানুষ মামলা করতে চায় না। পুলিশ চিহ্নিত সকল জায়গায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। একাধিক ছিনতাইকারী আটক করে মামলা দেয়া হচ্ছে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই তারা জামিনে বের হয়ে আসে। চুরি, ছিনতাই ও মাদক প্রতিরোধে পুলিশি নিয়মিত অভিযান অব্যহত রয়েছে।

(এসএস/এএস/ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪)