রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি: ফরিদপুরের ইয়াং লাইফ এসথেটিকস অ্যান্ড লেজার সেন্টার নামের বিউটি পার্লারটির মালিক শান্তা ইসলাম। অভিযোগ আছে, পার্লার ব্যবসার আড়ালে শান্তা করেন দেহব্যবসা ও ব্ল্যাকমেইলিং। এসব যেন ‘সবার জানা, কিন্তু কইতে মানা’ এর মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুবই চতুর প্রকৃতির শান্তা সবার মুখই বন্ধ রাখতে জানেন, জানেন নানান কৌশল ও ব্ল্যাকমেইলিং-এর বিভিন্ন পন্থা।

শান্তার ব্ল্যাকমেইলিংইয়ের শিকার হয়ে ফরিদপুরের বেশ কিছু মানুষ খুইয়েছেন লাখ লাখ টাকা। এই তালিকায় রয়েছে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আমলের কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কিছু সরকারি কর্মকর্তা, আছেন ব্যবসায়ীও। আসলে শান্তা একা নয়, তাঁর স্বামী রুমন ও কিছু দুর্বৃত্তের যোগসাজশে পার্লার ব্যবসার নামে ফরিদপুর, যশোর ও ঢাকায় চালিয়ে যাচ্ছে এসব দেহব্যবসা ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের কর্মকাণ্ড।

একসময় ৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করা শান্তা এসবের মাধ্যমেই মালিক হয়েছেন ফ্ল্যাট, বাড়ি, গাড়ি ও বিপুল পরিমাণে অর্থ সম্পদের। শান্তার স্বামী ফরিদপুর পৌরসভায় মাস্টার রোলে ৭/৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরিজীবী ছিলেন।

শান্তা ইসলামের ইয়াং লাইফ এসথেটিকস অ্যান্ড লেজার সেন্টারে ৫ মাস চাকরি করা সীমা নামে এক নারী উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, ‘আমি অনেক অত্যাচার সহ্য করে পাঁচ মাস কাজ করেছি। দেহব্যবসায় রাজি না হওয়ায় আমাকে মেরে বের করে দিয়েছে শান্তা ও তাঁর স্বামী। পাঁচ মাসের এক মাসেরও বেতন দেয়নি। কথা না শোনায় আমার খাবারও কেড়ে নিত ওরা। এমনকি অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও সহ্য করতে হয়েছে।’

সীমা বলেন, ‘আমি ভয়ে এতদিন মুখ খুলিনি। গরিব মানুষের মেয়ে আমি। ওরা অনেক ভয়ংকর, অনেক খারাপ মানুষ।’

‘আমি নিজে সাক্ষী, বাবু নামের একজনের থেকে শান্তা ব্ল্যাকমেইল করে অনেকগুলো টাকা নিয়েছে। এ বিষয়ে পাল্টাপাল্টি মামলাও হয়েছিল। বাবুর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে আবার তার সাথেই অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে যেতো শান্তা। ওর স্বামী সব জেনেও সবকিছু মেনে নিত। কারণ, শান্তার মাধ্যমে টাকা আসত।’

সীমা বলেন, ‘যখন কোনো পুরুষ পার্লারে আসত তখন সিসিটিভি ক্যামেরার মনিটর বন্ধ করে রাখা হতো। কখনোবা আবার সিসিটিভি ক্যামেরাও বন্ধ রাখা হতো, কাস্টমার ভেদে এসব কাজ করত শান্তা। শান্তা নিজে তো খারাপই, আমাকেও খারাপ বানাতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু আল্লাহর রহমতে পারেনি।’

শান্তা অসহায় সুন্দরী গরিব মেয়েদের টার্গেট করে চাকরি দিত। চাকরিতে যোগদানের সপ্তাহ যেতেই দেওয়া হতো দেহ ব্যবসায়ের অফার। প্রথমে মেয়েদের বোঝানো হয়, না শুনলে করা হয় শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার। এমনকি তাদের সামনে থেকে খাবার কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দেহ ব্যবসায় রাজি না হলে কোন মেয়ে ৪/৫ মাসের বেশি থাকতে পারেনা শান্তার পার্লারে, পেতো না কোন পারিশ্রমিকও।

এক প্রশ্নের জবাবে সীমা বলেন, ‘শান্তার ফরিদপুর, ঢাকা ও যশোর প্রত্যেকটি আউটলেটে একটা করে বিছানা আছে। সে যেখানে থাকে ওই বিছানায় নিজে একেক দিন একেক জন পুরুষ নিয়ে রাত কাটাতো। আমাকে সাথে নিয়ে ঢাকায় কোর্ট পর্যন্ত ঘুরেছে শান্তা। এসব নীরবে সহ্য করেছি কিন্তু কিছু বলিনি।’

সীমা আরও জানান, ‘আমাদের শুধু বাড়ির (পার্লার) ভেতরে কাস্টমারদের কাছে যেতে বলতো তা নয়, বাইরেও যেতে বলতো। আমি কোনোদিন তার অবৈধ প্রস্তাবে রাজি হই নাই বিধায় আমাকে দিয়ে পার্লারের কাজের পাশাপাশি বাড়ির যাবতীয় কাজ করাত শান্তা। এমনকি রান্না বান্নাও করতাম। কিন্তু রাতে কিছু গেস্ট আসবে বলে আমাদের ঠিকমতো খেতেও দিতো না। এমন অনেক রাত কেটেছে আমার অর্ধাহারে বা অনাহারে।’

সীমার মতো আরও দু'জন ভুক্তভোগীর সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা শান্তাকে ‘জঘন্য মহিলা’ ও ‘ভয়ংকর মহিলা’ বলে আখ্যায়িত করলেও প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে তাদের নাম প্রকাশে অনিহার পাশাপাশি অন্য কোনো বক্তব্য দিতেও রাজি হননি।

দেহব্যবসায় রাজি না হওয়ায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি রুনা লায়লা নামের এক প্রশিক্ষণার্থীর ওপর হামলা চালায় শান্তা ইসলাম ও তাঁর সহযোগী নাছির, তানিয়া ইসলাম, রুমন ও রাসেল। এসময় তারা পিস্তল ও ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে তিনটি সাদা স্ট্যাম্পে রুনা লায়লাকে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেছে বলে অভিযোগ রুনা লায়লার। এ ঘটনায় মামলা করেন রুনা লায়লা। তবে রুনা লায়লার দাবি, মামলার তদন্ত কর্মকতা মাসুদ ফকির শান্তা ইসলামের আস্থাভাজন ও ঘনিষ্ঠজন।

এই বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ ফকির উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, এসব ভিত্তিহীন ও মিথ্যা অভিযোগ।

মামলার এতোদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও আসামিদের গ্রেপ্তার না হওয়া নিয়ে মাসুদ ফকির উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, একজন আসামি পলাতক রয়েছেন, বাকিরা হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। জামিন উপেক্ষা করে তো তাদের ধরার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই সিসিটিভি ফুটেজ ও অন্যান্য বিষয়াদি তদন্ত করে সঠিক প্রতিবেদন তুলে ধরব। এতে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ নেই।’

এব্যাপারে অভিযুক্ত শান্তা ইসলামের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

(আরআর/এসএস/এসপি/মার্চ ০৪, ২০২৪)