ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


সারা বিশ্ব জুড়ে ৮ মার্চ দিনটি পালিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪। পৃথিবীর কোনও অংশে এটি উদযাপনের দিন, কোথাও বা প্রতিবাদের। দিনটির পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের ইতিহাস। বহু দেশে তাই দিনটি পরিচিত আন্তর্জাতিক নারী শ্রমিক দিবস হিসেবেই। ১৯০৮ সালে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন ১৫,০০০ নারী শ্রমিক। সেই থেকেই ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া এই দিনের। ১৯০৯ সালে আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। 

১৯১১ সালে এর পর অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সুইৎজারল্যান্ডে নারী দিবস পালিত হল ১৯ মার্চ। কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯১৩-১৯১৪ তে ২৩ ফেব্রুয়ারি আলাদা করে উদযাপিত হল নারী দিবস। রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রথম বার আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপিত হল ১৯৭৫ এর ৮ মার্চ। ২০১১ সালে পালিত হয় দিনটির শতবর্ষ। প্রতি বছর একটু একটু করে এগিয়ে ২০২৪ সালে আমরা পালন করছি ১১৩তম আন্তর্জাতিক নারী দিবস।

এ বছরের আন্তর্জাতিক নারী দিবস-এর থিম হল নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ"—এ প্রতিপাদ্যে আজ শুক্রবার পালিত হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, নারী-পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিত করা, নারীর কাজের স্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য উদ্‌যাপনের উদ্দেশ্যে নানা আয়োজনে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিনটি। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় দিবসটি পালন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলারা অর্ধেক কেন, আকাশের সিকি ভাগেও স্বাধীন ভাবে বিচরণ করতে বাধা পাচ্ছেন প্রতি পদে পদে। তবে মুদ্রার দু’পিঠই রয়েছে। একদিকে পুরুষের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে সমস্ত রকম পেশায় সমান সফল হচ্ছে মেয়েরা। অন্যদিকে আমাদের দেশেই এখনও কোনও কোনও গ্রামে কন্যা ভ্রূণ হত্যা হচ্ছে, বাল্য বিবাহ হচ্ছে, পণের জন্য হচ্ছে নির্যাতন, বধূহত্যা। তবে নারীযাপন নারী জীবন উদযাপিত হোক প্রতিটা দিন।

পরিবর্তনশীল এই বিশ্বে টিকে থাকতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সামনে নিয়ে আসতে হবে। এজন্য রাষ্ট্র, সমাজ এবং দেশের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবর্তন করতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি। এতে দেশ উন্নত হবে এবং নারীদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।’ আদিকালের সেই ঘটনা আরতো খাটে না। এখন সবার মুখ ফোটে। কারও বুক ফাটে না। লজ্জাবতী নারী দেখে কে বলেছে সেই কথা। যুগের হাওয়া বদলে গেছে। নারীর মনে নেই ব্যথা। নারীদের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে হবে। পুরুষতন্ত্রকে সমূলেই উৎপাটন করতে হবে।

প্রতিটি দিবসই কোনো না কোনোভাবে মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আমার কাছে ৮ ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস তেমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ, নারী দিবস মানে হচ্ছে নারী এবং নারীকেই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে তুলে ধরার একটা প্রয়াস। নারী তার অধিকার আদায়ে কতটা সংগ্রামী তা বিশ্বকে জানান দেওয়ার একটা বিশেষ পন্থা। একজন নারী চাইলেই তার সুনিপুণ কর্মদক্ষতা দ্বারা একটা জাতিকে সুশীল ও সুদক্ষ এবং একটি দেশকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারে। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে নারীরা পদচারণ করেনি। ঘর সামলানোর কাজ থেকে শুরু করে, কোট-কাচারী, অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি দেশ চালনার মতো কঠিন কাজেও নারীরা পিছিয়ে নেই। কিন্তু, আমার ভাবতেই অবাক লাগে যে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে নারী উন্নয়নের প্রধান বাধা 'পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি' যা মোটেই কাম্য নয়। এখনো কিছু কিছু কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা হয় যা একটা দেশের উন্নয়নের বাধা হতে পারে। আমার মতে, একটা দেশ তখনই স্বাবলম্বী হয়ে উঠে যখন সেই দেশের নারী এবং পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার সু্যোগ পায়। নানান ক্ষেত্রে বৈষম্য, নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও উন্নয়নমূলক প্রতিটি কাজে নারীরা অংশগ্রহণ করছে যা প্রশংসনীয়।

নারী দিবসের গুরুত্ব

নারী দিবসের গুরুত্ব, মাহাত্ম অনেকের কাছে খুবই হেয় করার মতো এবং গৌণ মনে হয়। এমন কি বুদ্ধিজীবী যারা অর্থাৎ কবি, সাহিত্যিক, লেখকদের মধ্যেও কেউ কেউ বলেন, এখন আর নারী দিবসের দরকার কি? নারী দিবসের দরকার কি কথাটার উত্তর গুরুত্বসহকারে দিতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে, স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব কি! বিজয়দিবসের গুরুত্ব কি! মাতৃভাষা দিবসের গুরুত্ব কি! আমরা কেন এসব দিনগুলো গুরুত্বসহকারে পালন করি! কেন এর মর্মার্থ তুলে ধরি! কেন বারবার স্মৃতির দরজায় টোকা দিয়ে তাকে জাগিয়ে তুলি। যেন মানুষ স্মৃতিভ্রষ্ট না হয়। মানুষ যেন বুঝতে পারে তার শিকড় কোথায়। যতই এই শিকড়ের সন্ধান মানুষ করবে, শিকড়ের কাছে বারবার ফিরে যাবে ততই মানুষ তার অবস্থানকে মজবুত করবে এবং চিন্তা-চেতনার জায়গাকে শাণ দেবে। সেইসঙ্গে জীবনকে ঋদ্ধ করবে। বুঝে নেবে তার করণীয়, দিব্যচোখে দেখে নেবে ভবিষ্যত। যার জন্য প্রতিনিয়ত আমাদের শুরু বা শিকড়টা বারবার বুঝে নিতে হয়। নারী দিবস সেই অর্থে গুরুত্ব রাখে সর্বাগ্রে। আর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সম্মুখযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার জন্য তিন লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন।

এসব তো অনেক আগের ঘটনা। তখন কমসংখ্যক মানুষ শিক্ষিত ছিল। আর এখন শিক্ষার হার বেড়েছে। মানুষের চিন্তাধারার উন্নতি হয়েছে। কিন্তু যখনই নারীর অধিকারের প্রশ্ন সামনে এসেছে, তখনই মানুষের চিন্তাধারা দেখে মনে হয়েছে, সমাজের অগ্রযাত্রা হয়তো আরও দু’শ বছর পেছনে চলে গেছে। আমরা মুখে নারী অধিকারের কথা বলব, অথচ ঘরের বউকে বাইরে চাকরি করতে দেব না। বিয়ের সময় মেয়ের বাবাকে যৌতুক দিতে হবে। মেয়ে যদি অল্প শিক্ষিত হয় তাহলে ভালো কথা; কিন্তু যদি উচ্চশিক্ষিত হয় তাহলে বিয়ের আগেই বলতে হবে- মেয়ে এখন যা করছে করুক, কিন্তু বিয়ের পরে চাকরি করতে পারবে না। আমরা মুখে বড় বড় কথা বলি, কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশের মানসিকতা এরকম। সব ধর্মেই মায়েদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে, মা স্বর্গের থেকেও বড়। তারপরও বাস্তব জীবনে অধিকাংশ নারী তাদের যোগ্য সম্মান পান না।

দেশের অর্ধেক মানুষ নারী। তাদের অগ্রাহ্য করে দেশ ও জাতির উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। নারীর অধিকার কখনও আপসে কেউ দেয়নি। যে অধিকার তাদের প্রাপ্য তা কেন আইন পাস করে তাদের দিতে হবে? নারীদেরই তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন তাদেরকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এ সমাজে মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া মানেই সারা জীবন সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে। তাই প্রত্যেক মেয়েকেই শিক্ষিত হতে হবে নিজের চেষ্টায়। যে পরিবারের সমর্থন পাবে, তার চলার পথ সহজ হবে; যে পরিবারের সমর্থন পাবে না, তার চলার পথ কঠিন হবে- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাকে এ সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আর আমাদের পুরুষদের নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পরিশেষে, মায়েদের ত্যাগ ও ভালোবাসা ছাড়া মানবীয় প্রতিভার বিকাশ ও সমাজের স্থায়িত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। মায়েরাই সমাজের প্রধান ভিত্তি তথা পরিবারের প্রশান্তির উৎস।

পরিশেষে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির জনকের দর্শন অনুসারে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নতুন ধারার সূচনা করেন। শেখ হাসিনার গৃহীত উদ্যোগের ফলে উচ্চশিক্ষাসহ সব ধরনের শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর শতভাগ অংশগ্রহণ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উদ্যোক্তা তৈরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সুরক্ষা ও নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের পাশাপাশি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় নারীর নিরাপত্তা, সুরক্ষা, বাল্যবিয়ে ও যৌতুক প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। নারী ও শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ের এবং বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন কঠোরভাবে দমন এবং প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদারকরণের লক্ষ্যে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০’-এর ধারা ৯-এর উপধারা (১)-এর অধীন ধর্ষণের অপরাধের জন্য ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শাস্তির পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড’ করা হয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনীতির সব কার্যক্রমে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশ উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে। তাই নারীদের অধিকারগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন হলেই ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বিনির্মাণ হবে সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ সোনালি সমাজ।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।