পীযূষ সিকদার


গত ২৯ ফেব্রুয়ারি নাটক দেখবো বলে ঢাকা গেলাম। আগে তো ড.ইসরাফিল শাহীন ভাইয়ের নির্দেশনায় নাটক দেখি নাই! কষ্ট হলেও দূর থেকে আগমন। আমার ইচ্ছা তাঁর নির্দেশনায় নাটক দেখা। ঈশ্বর অলক্ষে হাসেন। আমি যথাআজ্ঞা দিয়ে নাটক দেখতে ঢুকলাম। যথারীতি নাটক শুরু হলো। আমার ভালোলাগা তৈরি হলো। তাঁর কাছ থেকে গোচর-অগোচরে জেনেছি অনেক। এক বিস্ময়কর নান্দনিক মানুষ! তাঁর সম্বন্ধে বলতে গেলে দিন ফুরোবে। আমার কর্ম তাহা নহে। তবুও পূণ পূন বললাম- মানুষটি তাঁকে আমাকে সুরে সুরে গ্রন্থিত করেছে আপন বলয়ে। যেনো হাজার বছর ধরে আত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন। সে মিলনে ছেদ ঘটলেও পূর্ণছেদ ঘটেনি।
যাই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সিদ্ধান্ত নাটকটি দেখলাম। রচনা-বার্টল্ট ব্রেখট, অনুবাদ ও পুনর্লিখন : ড. শাহমান মৈশান ও নির্দেশনা ও প্রমোদণা দেন, ড. ইসরাফিল শাহীন। সিদ্ধান্ত নাটকটি সর্বসাকুল্যে মুক্তিযুদ্ধের কথা প্রকটভাবে উঠে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমন্ডলে উপস্থিত সভামন্ডলীর মুহুরমুহু হাতে তালি যেনো বাদ্যযন্ত্রকেও হার মানায়।

সিদ্ধান্ত নাটকটির গল্প হুবহু তুলে দিলাম-সিদ্ধার্থ প্রকৃতপক্ষে কয়েকজন বিপ্লবীর এক সংকটাপন্ন পরিণতিকে নির্দেশ করে। এক তরুণ কমরেডের আবেগের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির কৌশলগত বিপ্লবের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। আর পার্টি থেকে বিচ্যুত কিন্তু দুর্দশাগ্রস্ত জনতার প্রতি মমত্ত্ব সত্ত্বেও শুধুমাত্র বিল্পবকে সমুন্নত রাখতে এই তরুণ কমরেডের মৃত্যুর মতো পরিণতি বরণ করতে হয়। এই মৃত্যু হত্যা নয় আবার আত্মহত্যাও নয়, তাহলে কী এই মৃত্যু! বিপ্লব, সংঘাত ও ভাবাবেগের সংশ্লেষে নির্মিত নাট্য প্রযোজনা হলো সিদ্ধান্ত।

অভিনয় যে অভিনয় নয়-এ নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীগণ বুঝিয়ে দিলেন। এ চাক্ষুষমান না হলে এ বোঝা সম্ভবপর নয়। বাস্তব ও অভিনয়ের যৌথ মিথষ্ক্রিয়ায় নাটক সিদ্ধান্ত। এ কথা সত্য যে বাস্তব! কিন্তু বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে কথা, সুর, দেহসৌষ্ঠব নিয়ে এই নাটকের পূনর্লিখন। পূনর্লিখনের সৃজনে সৃজনে বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথা বলে দেয় সিম্বলিক ভাষায়। নাটকটি অষ্টম পর্বে বিভক্ত। পর্ব বিভাজন না টেনে অদ্বৈত হলে মন্দ কী হতো! সত্য কথা এই যে, নাটকটির মূলে মৃত্যু ও মৃত্যুহীনতার গল্প বলে যায় অনিবার্যতায়! কমরেডগণ শেষাবধি একের পর এক ভুল করে যায়! খুন করে ফেলে নিজেকেই। আমার দেশ বাদ দিয়ে বিদেশী স্বর্ণমুদ্রা ভালো নয়। আমি তো এ নাটকে ঢুকেই রক্ত দেখে নিয়েছি! তারপরও কমরেড (ভাষক) বলছে, মৃত্যু ও মৃত্যুহীনতার গল্প। এখানে আমি বোবা-কানা। মাথা কই? চুলে হাত দিয়ে দেখি মাথা পূর্বের জায়গায় আছে! তাই বারবার চেষ্টা করি। চুল টানি। মাথা আছে আবার মাথা নেই! আবার বলি, নাটকটি দর্শনে আমি নিরোগ হয়েছি। পূজ্যপাদ ড. ইসরাফিল শাহীনকে শত কোটি প্রণাম। এমন একটি নাটক দেখবার সুযোগ করে দিয়ে।

নাটকটি সবুজ পত্রের ন্যায় গল্প বলে যায় সৃজনে সৃজনে। সত্য এই-সত্য আর মিথ্যার প্রভেদসম এ নাট্য। নাটকটিতে অভিনেতাবৃন্দ অভিনেতা হয়ে যায় আবার কখনো কখনো কথক হয়ে আবার কখনো অভিনেতা হয়ে। যাঁরা দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেলেন-তাঁরা হলেন, অভিনয়: স্নাতকোত্তর দ্বিতীয়সেমিস্টার, ২০২২-এর পরীক্ষা মূলক প্রযোজনা মো.তানভীর আহম্মেদ, নাসরিন সুলতানা অনু, ওবায়দূর রহমান সোহান, প্রণব রঞ্জন বালা ও মনোহর চন্দ্র দাস। নাসরিন সুলতানা অনুকে ভালোর ভালো না বললে লেখকের দায় এড়ায় না। আলো আমার প্রিয় বিষয়। পূজ্যপাদ ড. ইসরাফিল শাহীন আলোর রীতি মেনে চলেছেন। তাই সাধু সাধু বলে উঠি। আলোক সহযোগী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন-ধীমান চন্দ্র বর্মণ। দেহসৌষ্ঠব ও চলন বিন্যাস করেছেন অমিত চৌধুরী। একে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। সঙ্গীত পরিকল্পনায় সাইম রানা যেনো সুরে সুরে ঝড় তোলেন। সঙ্গীত উদ্দীপক ও প্রণোদনা রাহুল আনন্দ। একে নতুন করে বলবার নয়। তাল-বাদনে অমিত চৌধুরী।

পোশাক পরিকল্পনায় মহসীনা আক্তার। একটু মনোযোগী হলে ভালো হতো। অ্যাবস্ট্রাকট চিন্তাটি আমার ভালো লেগেছে। পোশাক সহযোগী: উম্মে হানী, মুনিরা মাহজাবিন মিমো। দ্রব্য পরিকল্পক-আহসান খান। নিত্য নিত্য চাওয়া তিনি যেনো ভালো করেন!

সবশেষে বলি, সিদ্ধান্ত প্রযোজনা গভীর চলনের কথা বলে। এ প্রযোজনা বৈশ্বিক হয়েও আমাদের সোনার বাংলার কথা বলে। চৌকোণ উচ্চতায় লাল সিম্বল প্রথমে লালের কথা বলে। পরে টুপি শোভা পায় কমরেডদের মাথায়। আমার বোঝার কথা নয়। অবাধ্য সন্তান তো! একটু বেশিই বুঝি! অবলীলায় আমি বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণপূর্বক দর্শকের কাতারে বসে রইলাম! আমাকে কেউ ফেরায় না! আমিই ফিরি সবুজের টানে...। আর একটা কথা না বললেই নয়। যদিও পূর্বেই বলা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নাটক সৃজনে সৃজনে মাতুক। মাতুক বাংলা নাট্য। তাই পূজ্যপাদ ড.ইসরাফিল শাহীন। সুন্দরের কথা বলে যায় অবলীলায়। এ রকম মহিমান্ডিত সেট এই অধমের চোখে পড়েনি। এক বিষ্ময়ভরা চোখ দিয়ে! চিহ্ন এঁকে এঁকে অসাধারণ নৈপূন্য দেখিয়েছেন আমার পূজ্য শিক্ষক ড.ইসরাফিল শাহীন। তাঁর হাত ধরে বাংলা নাটক ঝংকৃত হোক বিশ্ব দরবারে। এ আমার অনিত্য নিত্য চাওয়া। জয় হোক বাংলা নাট্যের। জয় হোক থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের। যিঁনি এই বিভাগের জন্মলিপি লিখে গেছেন-তাঁকেও বলি, আমার দুবাহু যেনো আপনার চরণ ছোঁয়। জানি সে দুহাত পৌঁছে গেছে আপনার চরণ তলে।

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।