স্টাফ রিপোর্টার, টাঙ্গাইল : রমজানে ইফতারিতে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে আমরা খেজুর, কলা, আনারস, তরমুজ, আপেল, কমলা, আঙ্গুরসহ হরেক রকমের দেশী-বিদেশী ফল রাস্তার মোড়ে, ফুটপাতে ও ভ্যানে যেখানে পাই সেখান থেকেই কিনে থাকি। এতো ফলের ভীরে কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ এতো ভাবার ফুসরৎ আমাদের   থাকে না। খোলা চোখে দেখতে যে ফলটা সুন্দর মনে হয় তাই আমরা বাজার থেকে কিনে আনি। আর এ সুযোগেই অসাধু ফল ব্যবসায়ীরা ফলে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করে আমাদের ঠকিয়ে লাভবান হচ্ছেন। 

রমাজান উপলক্ষে বাজারে যত ফল পাওয়া যাবে তার মধ্যে টাঙ্গাইলে রসে ভরা টুইটুম্বুর মধুপুরের আনারস ব্যাপক সমাদৃত। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির আনারস চাষ হয়ে থাকে। এরমধ্যে জায়াণ্টকিউ ও হানিকুইন জাতের আনারসের চাষ বেশি হয়ে থাকে। জায়াণ্টকিউ স্থানীয়দের কাছে “ক্যালেন্ডার” আর হানিকুইন আকারে অনেকটা ছোট, স্থানীয়দের কাছে এটা “জলডুগী” নামে পরিচিত।

সাইজে ছোট, দেখতেও বেশ আর্কষনীয় আর খেতে সুস্বাদু হওয়ায় হানিকুইন জাতের আনারসকে
স্থানীয়রা আদর করে নাম দিয়েছে “জলডুগী”। আদর করে জলডুগী নামে ডাকলেও জলডুগীর লালন-পালন মোটেই সুবিধের নয়। মৌসুমের আগেই বাজারে আনতে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক দিয়ে আনারসে পরিপুষ্টের রূপ দেওয়া হচ্ছে জলডুগীকে বেশি দামে বিক্রি করা যাবে এই আশায় ।

টাঙ্গাইলের মধুপুরের চাষীরা রাসায়নিক ও হরমোন বিষে ভরা আনারস এই রমজানে বাজারজাতের মাধ্যমে অধিক মুনাফার লোভে এসব অপর্কম করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাগানে সদ্য ফোঁটা ফুল, রেণ (গুটি) ও আনারসে প্রতিদিন পরিচর্যার পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগ করার ফলে ১৮ মাসে পরিপক্ক হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৫-৬ মাসেই আকারে বড় হয়ে পূর্ণতার রঙ-রূপ ধারণ করছে।

আনারসে ফুল আসলেই বেনসালফিউরন মিথাইল ও এসিটাক্লোর সমন্বয়ে একটি গ্রোথ হরমোন স্প্রে করা হয়। আনারস গাছে ৬০ পাতা হওয়ার পর প্রাকৃতিকভাবেই আনারস আসার কথা। কিন্তু ২৮ পাতা হওয়ার পরই দ্বিতীয়বার এক ধরণের ক্ষতিকারক হরমোন ব্যবহার করে অপরিপক্ক গাছ থেকে কৃত্রিমভাবে ফল বের করে আনা হচ্ছে। এই হরমোনকে স্থানীয় কৃষকরা ‘গর্ভবর্তী’ বলে। আনারস একটু বড় হলেই তাতে ইথোফন বা রাইপেন নামক রাসায়নিক স্প্রে করে। এতে মাত্র তিন থেকে চারদিনেই আনারস পরিপূর্ণ আকৃতি পায়। শুধু কি ইথোফন/রাইপেন?

স্থানীয় অনেকে বলছেন, রাইপেন, ইথোফনের সঙ্গে আনারসে স্প্রে করা হয় পটাশ, ফরমালিন, শ্যাম্পু, সিঁদুর, স্প্রিরিটসহ বিভিন্ন রাসায়নিক। এসব বিষাক্ত স্প্রে দেয়ায় পতঙ্গ বা শিয়াল-কুকুরও আনারসের ক্ষতি করছে না। অল্প সময়ে আনারসে রঙ আনার জন্য তৃতীয়বার গাছে ক্ষতিকারক ক্রফকেয়ার, ফ্লুরা, ভিটামিন পিজিআর গোল্ডসহ বিভিন্ন ঔষধের স্প্রে করা হয় ।

সবশেষে স্প্রে করা হয় মরণনাশক ফরমালিন। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত হরমোন প্রয়োগে নষ্ট হচ্ছে আনারসের স্বাদ ও উপকারিতা। হরমোন সম্পর্কে প্রান্তিক চাষিদের কোন ধারণা নেই। অজ্ঞ কৃষক ঔষধের প্রয়োগ নীতি না জেনে মানব জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে। আবার কেউ কেউ জেনে-বুঝেও অতি লাভের আশায় এসব ঔষধ প্রয়োগ করেন। শুধু জমিতে নয় বাজারেও মেশিন নিয়ে কিছু ফরমালিন স্প্রেম্যান দেখা যায় যারা আনারসের বাগানে গিয়ে পরিপক্ক আনারসে ফরমালিন স্প্রে করে আসেন। আর স্প্রে করার একদিন পর কাটা হয় আনারস। আর এভাবেই রসে ভরপুর, খেতে সুস্বাদু ব্যাপক সম্ভাবনাময় মধুপুরের আনারস দিন দিন কৃত্রিম রসে পরিণত হচ্ছে। চারা থেকে পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগে আনারস দ্রূত পরিপক্ক করার প্রতিযোগিতা চলছে। কৃত্রিমভাবে দ্রুততম সময়ে পাকানো ও দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণের জন্য মানুষ শরীরের জন্য ক্ষতিকর ফরমালিন আনারসে মেশানো হচ্ছে।

বার বার বাগানে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ও হরমোন প্রয়োগে আনারসের স্বাদ ও উপকারিতা নষ্ট হওয়া সম্পর্কে অধিকাংশ চাষীদের কোন ধারণাই নেই। ওষুধ প্রয়োগ নীতি না জেনে তারা নিজেদের ও অন্যের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন। কেউ কেউ জেনে-বুঝে অতিলোভে বাগানে ওষুধ প্রয়োগ করছেন। আনারস চাষীদের মতে, চারা রোপনের পর গাছ থেকে ফুল বের হওয়ার আগে প্রথম রাসায়নিক দিতে হয়। এর ২০-২২ দিন পর আবার স্প্রে করতে হয়। রেণু বা গুটি হওয়ার পর দ্বিতীয়বার এবং এর দেড় মাস পর ফল পাকানোর জন্য রাসায়নিক স্প্রে করতে হয়।

মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগকারী চাষীরা নাম প্রকাশ না করে জানায়, তারা আগে রাসায়নিকমুক্ত আনারস চাষ করে লোকসান গুনেছেন। ভোক্তা পর্যায়ের ক্রেতারা দেখতে রসালো, মনলোভা হলুদ রঙের আনারস বেশি কিনে থাকে। রাসায়নিকমুক্ত আনারস অনেকটা কাঁচা-কাঁচা ধূসর রঙের হয়- দেখতে রসালো দেখায়না। তাই ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ক্রেতাদের মনতুষ্টি করতে তারা বাধ্য হয়ে রাসায়নিকযুক্ত আনারস চাষ করে থাকেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, আনারসে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার হয় সেগুলো মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আনারসসহ যেকোন ফলে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহারে শ্বাসনালী, লিভার, কিডনীসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে গর্ববতী মা ও শিশুরা হুমকির মুখে পড়ে। এছাড়া মরণনাশক এসব ঔষধ প্রয়োগ ক্যান্সারের জন্যও দায়ী হতে পারে।

(এসএম/এসপি/মার্চ ১০, ২০২৪)