রহিম আব্দুর রহিম


কয়েকদিন আগে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জাতি জানতে পেরেছেন, সাভারে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে মারাত্মক আহত হয়েছে দুই স্কুল শিক্ষার্থী। আহত এবং আক্রমনকারীদের মধ্যে দুইজন কিশোর বাকীরা শিশু বয়সের। ১৯ মার্চ জাতীয় এক দৈনিক পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি সংবাদ শিরোনাম ছিলো, "কিশোর গ্যাংয়ের প্রধানসহ ২০ সদস্য গ্রেপ্তার, "নিউজের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, 'রাজধানীর কদমতলী, হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ২০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব -৩। গ্রেপ্তারকৃতদের কাজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ১টি চাপাতি, ১টি ছুরি, ১টি শাবল, ৩টি ছোরা, ১টি হাসুয়া, ৪টি চাকু, ২টি ক্ষুর, ২টি হেস্কোব্লেড, ৬টি মোবাইল ফোনসহ নগদ ৪ হাজার ৫৪০ টাকা।'

এদেরকে যে অর্থে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বলা হয়েছে তা কতটা যৌক্তিক? সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে। এরা ব্যর্থ সমাজ, পরিবার কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিপথগামী অপশক্তি। কারণ পৃথিবীর সকল ইতিবাচক কর্মকান্ডের ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে গ্যাং কালচারের মাধ্যমে। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বোপরি মাঠ জয়ী সকল বিশ্বজয়ী সকল ক্রীড়া নৈপুণ্য। দেশের চতুর্থ বারের মত নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রথম ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে সুনির্দিষ্ট তিনটি বিষয়ে কঠোরভাবে প্রতিপালন ও নজরদারি বাড়াতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছেন। এরমধ্যে সারাদেশে ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড সবাই যাতে মেনে চলে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা, খাদ্য মজুত ও ভেজালের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া এবং হঠাৎ বেড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করার।

কিশোর গ্যাং সমস্যার প্রসঙ্গ এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "যখন ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে সেই সময় এই সমস্যাটা। এটি কোভিড-১৯ চলার সময় বিস্তার লাভ করেছে। ওই সময়ে এটি সব থেকে সামনে এসেছে। এজন্য এলাকাভিত্তিক নজরদারি বাড়াতে হবে। যারা লেখাপড়া করবে, তারা তা না করে কেনো বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জাড়াবে? এ ব্যাপারে কমিশনারগণ জেলা প্রশাসকবৃন্দ বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকদের নিয়ে সকলের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যেনো কারো ছেলেমেয়ে এধরণের কিশোর গ্যাং, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকাসক্তে জড়িয়ে পড়তে না পারে।সেজন্য প্রতিটি পরিবারকে নিজ নিজ সন্তান সন্ততিদের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে।"

তিনি প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের গুরুত্ব আরোপ করে আরও বলেন, "পরিবারগুলোকে একটু সচেতন করতে হবে শুধু গ্রেফতার করে বা ধরে লাভ নেই। কারণ, সেখানে (জেলে) থাকা বড় অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে এরা আরো বড় কোন ধরনের অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। সে কারণে আমাদের গোড়া থেকেই ধরতে হবে এবং পরিবার থেকেই তা শুরু করতে হবে।" প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় স্পষ্ট হয়েছে, "সাপ মারতে হবে, তবে কোনভাবেই লাঠি ভাঙ্গা যাবে না।"

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ছুটি গল্পে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করেন, 'তেরো চৌদ্দ বছর বয়সের মত বালাই পৃথিবীতে নাই।' অর্থাৎ যাদের বয়স তেরো-চৌদ্দ তারা সমাজে এক প্রকার আপদ বিপদের নাম।এই তেরো থেকে আঠারো বয়সের কিশোর কিশোরীরাই আন্তর্জাতিক পর্যায় টিনএইজ বলে পরিচিত। তবে এই টিনএইজদের সাথে বিভিন্ন গঠনমূলক ও ক্রিয়েটিভ কাজ করে কি যে মজা, আনন্দ! তা ভাষায় প্রকাশ করা দুষ্কর। এদের মন-ধ্যান, চিন্তা-চেতনা বুঝে তাদের কাজে লাগানো গেলে এরাই যে সমাজের শক্তিশালী মানব সম্পদ তা দ্রুত সুপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অথচ বর্তমানে এই বয়সের সম্ভাব্য শক্তিধর মানব সম্পদরা সুধিসমাজে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তালিকায় কিংবা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলে কিশোর গ্যাং নামে পরিচিত। স্বাভাবিক অর্থে, 'গ্যাং মানেই তারা সংঘবদ্ধ অপরাধী !' এই অপরাধ প্রবণতায় কিশোর-কিশোরী কোন সময়, কোন অবস্থায় ঝুঁকে পড়ে?তা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়, এই বয়সে তারা পরস্পরের প্রতি সহনশীল এবং আবেগের বন্ধনে আটকে যায়। সৃষ্টি হয় পরম বন্ধুত্ব।দলবেঁধে কাজ করতে আনন্দ পায়। দিতে চায় নেতৃত্ব। এদের আত্মসম্মানবোধ প্রবল আকার ধারণ করে। ফলে তারা পারিবারিক, সামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স স কর্মের স্বীকৃতি চায়। কৌতুহল বশত তারা রঙ্গিন জগত খুঁজে ফিরে। যা কোন অপরাধ বা অন্যায় কিছু নয়।

পৃথিবীর সকল মানব জাতিরই যা স্বভাব গত বৈশিষ্ট। কিন্তু বেশির ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাবা-মা,পাড়া-প্রতিবেশী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা গুরুজনরা তাদের ইতিবাচক কর্মকান্ডের গুরুত্ব না দিয়ে, চরম অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেন; কোন কোন ক্ষেত্রে এদের বেয়াদব বলে অপমানও করা হয়ে থাকে। ভুলের খেসারত হিসেবে তাদের মাথা ন্যাড়া বা থানায় মুচলিকা দিবার কাহিনীও রয়েছে। এক সময় এরা প্রতিশোধ বা বীরত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে কৌতূহল বশত নেতিবাচক গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে, যা কি না তাদের অজান্তে ঘটে থাকা এক প্রকার বয়সের দোষ। এই বয়সের 'দোষ'কে গুণে পরিনত করার দায়িত্ব আসলে কার? প্রথমে পরিবার। যেখানে এই বয়সের একজন কিশোর-কিশোরীরা তার মা বাবাকে বন্ধু হিসেবে এবং শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও নিজেকে সফল, সার্থক এবং সুখি মনে করার মত পরিবেশ পাবে।

দ্বিতীয়ত সমাজ, যেখান তারা উপলব্ধি করতে পারবে তাদের আশে পাশে যে বা যারা রয়েছেন, তাঁরা সবাই একে অন্যের আপনজন। সর্বোপরি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। যেখানে টিনএজদের শিক্ষাদান পদ্ধতি হতে হবে দলগত এবং আনন্দঘণ। যা বর্হিবিশ্বে প্রচলিত রয়েছে। যে শিক্ষায় শিক্ষার্থীরা প্রকৃতি, পরিবেশ, মাটি-মানুষের সাণিধ্যে গড়ে ওঠা, ধর্ম-কর্মের প্রাণান্ত মহাযজ্ঞে শামিল হতে পারছে। ফলে সেই সমস্ত দেশের টিএনএইজরা কোনক্রমেই নেতিবাচক কর্মের দিকে ধাপিত হবার সুযোগ পায় না। আমাদের সেই ধরণের শিক্ষাদান পদ্ধতি দীর্ঘসময় অনুপস্থিত ছিলো। বর্তমান শিক্ষাক্রমে যার পুরোপুরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের কোথায় কিশোর গ্যাংদের নেতিবাচক কোন কর্মকান্ড থাকবে না, থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে চতুরমুখি প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর শতভাগ উপস্থিত নিশ্চিত করণ। পাঠদান প্রক্রিয়া যেকোন মূল্যে যথারীতি বাস্তবায়ন। পাড়া মহল্লা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা জোরদার করণ।

মনে রাখতে হবে, দায়িত্বশীলদের চরম ব্যর্থতাই মূলত কিশোররা নেতিবাচক গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ে। কঠোর হতে হবে, যদি কখনও কোন দুষ্টু কিশোর গ্যাংয়ের আর্বিভাব ঘটে তবে শুধু সংশ্লিষ্ট কিশোরদেরই নয়, এই ধরণের গ্যাং সৃষ্টির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ব্যর্থ মহলের ব্যক্তিদেরকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কোনক্রমেই রঙ্গিন জগতের কৌতূহলী কিশোরদের যেমন অপরাধের কালিমা লেপনে করা যাবে না; তেমনি কোনভাবেই পরিকল্পিতভাবে অপরাধের সাথে জড়িতদের কোনক্রমেই ছাড় দেয়া উচিৎ হবে না। আমরা চাই 'দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন' নীতি বাক্যটির বাস্তব রূপদানের সর্বজনীন পদক্ষেপ।

লেখক : শিক্ষক ও শিশু সাহিত্যিক।