স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ : ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে যশোর জংশন রেলওয়ে স্টেশনের পাশে দীনি ইলেম শিক্ষার জন্য জামিয়া এজাজিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়।

যশোরের দানবীর চৌধুরী আলতাফ হোসেনের নিজস্ব জমির উপর স্থানীয় লোকদের সহযোগিতায় এই মাদ্রাসার আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যশোরের প্রসিদ্ধ আলেম আবুল হাসান যশোরী। বাংলাদেশের যশোর অঞ্চলের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এই মাদ্রাসা বধ্যভূমি হিসাবে পরিচিত।

মুক্তিকামী জনতাকে এই মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে গুলি করা হয়। ২৫ শে মার্চের গণহত্যার পর এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ রেলস্টেশন মাদ্রাসায় অবস্থান করে। তৎকালীন যশোর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ঝিনাইদহ জেলার আওয়ামী লীগের নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মঈনউদ্দিন মিয়াজী তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও সন্তানসহ এই মাদ্রাসায় আশ্রয় নেয়।

এই খবর জানতে পেরে হানাদার বাহিনির সদস্য ও রাজাকারের দল মিলে ৪ঠা এপ্রিল মাদ্রাসায় হামলা করে। সেখানে শিক্ষক হাবিবুর রহমানসহ ৫জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া আব্দুর রউফ মাস্টার, কাজী আব্দুল গণীসহ স্থানীয় আরও অনেকে শহীদ হন। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতায় ২১ জন মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। সব মরদেহ মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে গণকবর দেওয়া হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আবুল হাসান যশোরী।

শুধু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সমৃদ্ধ নয়, যশোর রেলস্টেশন মাদ্রাসার রয়েছে গৌরবময় অতীত। এখানে ১২ টি বিভাগে শিক্ষা দেওয়া হয়। রয়েছে প্রাইমারি বিভাগ, হিফজ বিভাগ, কিতাব বিভাগ, তাফসির বিভাগ, ক্বেরাতে সাব্আ, ফতওয়া ও ফারায়েজ বিভাগ, কম্পিউটার বিভাগ, দর্জি বিজ্ঞান বিভাগ, গণপ্রশিক্ষণ বিভাগ, দাওয়াত ও তাবলীগ, কুতুবখানা বা লাইব্রেরী, দারুল মুতালায়া বা ছাত্র পাঠাগার। এখানে প্রায় সাড়ে ৬শ শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে। আরবি মাস হিসেবে বছর গণনা করা হয়।

প্রতিবছর শিক্ষা শেষে পুরাতন ছাত্ররা মাদরাসা ছেড়ে চলে যায়। আবার নতুন ছাত্র ভর্তি হয়। মাদ্রাসাটিতে ৪৯ জন শিক্ষক কর্মচারীর নিবিড় পর্যবেক্ষণে সুষ্ঠ ও সুন্দর পরিবেশে আবাসিক, অনাবাসিক ভাবে শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। প্রথমে ভর্তির জন্য প্রত্যেক ছাত্রকে ৪৬শ টাকা খরচ বহন করতে হয়। আবাসিক ছাত্রদের খাবারের জন্য প্রতি মাসে ২৫শ টাকা খরচ হয়। আয়ের উৎস বলতে সাধারণ ফান্ড ও লিল্লাহ ফান্ড থেকে কিছু টাকা জমা হয়। তবে আয়ের টাকা মাদ্রাসা ও ছাত্রদের কল্যাণে ব্যয় করা হয়।

যশোর রেলওয়ে মাদ্রাসায় মুহ্তামিম হিসেবে ১৯৯৩ সাল থেকে আলেম আবুল হাসান যশোরীর ছেলে মাওলানা আনোয়ারুল করিম যশোরী দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিষ্ঠানটি আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধিভুক্ত। এখানে ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়। শেখানো হয় বাংলা, ইংরেজিও। বর্তমানে মাদ্রাসাটি সম্প্রসারণ করে ৪তলা বিশিষ্ট নতুন একটি ভবণ নির্মাণ করা হচ্ছে। নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয় ছাত্র সংখ্যা আরও বাড়ানো সম্ভব হবে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার সাক্ষি রেলওয়ে মাদ্রাসা অতীত এক গৌরবময় অধ্যায় বহন করে চলেছে। এই অঞ্চলের সব চেয়ে বড় গণকবর বুকে ধারণ করে শিক্ষার আলো ছড়ানো এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করবে এমনটাই প্রত্যাশা।

(এসএমএ/এএস/এপ্রিল ০১, ২০২৪)