রহিম আব্দুর রহিম


বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্যকলা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ভারত-পশ্চিমবঙ্গের তা থাই নৃত্যকলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ অর্পিতা বিশ্বাসের আমন্ত্রণে এবার বোলপুর যাওয়া। তাঁর আয়োজিত বসন্ত উৎসব ১৭ মার্চ। বহুবার ভারত যাওয়া হলেও এবারই প্রথম বোলপুরের শান্তিনিকেতনে পদার্পন। উৎসবের একদিন আগেই এনজিপি থেকে রওনা হলাম গন্তব্যের উদ্দেশে। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে শতাব্দী এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি গিয়ে দাঁড়ালো বোলপুর রেলওয়ে স্টেশনে। নামামাত্রই ফোন পেলাম মধ্য বয়সী যুবক প্রভাকর ঘোষের। আয়োজকরা এই যুবককে আমার গাইডার হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রথমে আবাসনে, এরপর বিকাল বেলায় ঘুরে দেখার পালা। 

প্রভাকর শিক্ষা-দীক্ষায় স্নাতক পাশ। টটো চালান বোলপুরের শান্তিনিকেতনে।ওর টটোর যাত্রী হবার সৌভাগ্য হয়েছিলো ১৬ মার্চ। সবুজ শ্যামলিমায় পরিপূর্ণ এক অপূর্ব গ্রাম শান্তিনিকেতন! গ্রামটির জন্মকথাও বেশ মজাদার।বীরভূম জেলার ভূবনডাঙ্গা। এই গ্রামে বসবাস করতো ভূবন নামক এক কুখ্যাত ডাকাত, এই ডাকাতের নামেই ওই গ্রামের নাম হয় ভূবনডাঙ্গা। কালের আর্বতে গ্রামটি এখন শহর, নাম যার বোলপুর। ময়ূরাক্ষী নদীর উপনদী ‘কোপাই’। যে নদীটি শান্তিনিকেতন, বোলপুর, কঙ্কালীতলা ও লাভপুরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত। গ্রামগুলোর মধ্যে বোলপুর প্রকৃতির এক স্বর্গীয় শহর। এই শহরের হৃদপিণ্ডই রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। এই শান্তিনিকেতন নামটি কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে রাখেনি, জনশ্রুতি থেকেই যার নামকরণ।

১৮৬২ মন্তান্তরে ১৮৬৩ সালের দিকে রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, প্রখর একদুপুরে রায়পুরে যাচ্ছিল, পথে লাচচে মাটির বোলপুর (ভূবনডাঙ্গায়) পৌঁছালে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বিশ্রাম নেন ছাতিমতলায়। জায়গাটি তাঁর পছন্দ হয়।এই জমিটি ছিলো তৎকালিন রায়পুরের জমিদারদের। পরে তিনি ছাতিম গাছসহ ওই জায়গা তাঁদের কাছ থেকে কিনে নেন। গড়ে তোলেন উপাসনা এবং প্রতীক্ষালয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছোট থেকে বাবার সাথে বোলপুরে আসা-যাওয়া করতেন। আসা-যাওয়া সুবাদে ১৯০১ সালে যিনি ওখানে ব্রহ্ম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৫ সালে কবির বাবা মারা যান।জমিদারি দায়িত্ব পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে ব্রহ্ম বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে ১৯১৮ সালে ২৩ ডিসেম্বর কবি নিজের হাতে বিশ্বভারতী বিশ্বিবিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। চলছে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আশ্রম ও গবেষণা কেন্দ্র। পাখ-পাখালির কলকাকলি মুখরিত শান্তিনিকেতনে সন্ধা নামে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে। বাতাসে কান পাতলে ভেসে আসে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর।

বিকেল হলেই খোয়াইয়ের হাট, কোপাইনদীর পাড় বাউলের একতারা, দুতারা, খমক, খুঞ্জুরি, মন্দিরা ও ঢোলের তালে উত্তাল হয়ে উঠে। পূর্ণিমা রাতের সোনাঝুরির রূপ লাবণ্যে মেতে উঠে সাহিত্য প্রেমিরা।এখানকার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, আম্রকানন, ছাতিমতলা, তালগাছ, রবী ঠাকুরের বাড়ি, পৌষমেলার মাঠ, সৃজনী শিল্পগ্রাম প্রতিটিই সাহিত্য সাধকদের রসদ হয়ে দন্ডায়মান। ২০০৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সবুজে ঘেরা কারুকার্য খঁচিত সৃজনী শিল্পগ্রাম। যেখানে শোভা পাচ্ছে ওড়িশা, বিহার, সিকিম, অসমসহ সাত রাজ্যের শিল্প এবং আন্দমান নিকবর দীপপুঞ্জের নিদর্শন। প্রতীক হিসেবে রয়েছে প্রতিটি রাজ্যের একটি করে কুটির। শান্তিনিকেতন চত্বরে লক্ষণীয় রাম কিঙ্কর বেচ নির্মিত ভাস্কর্য 'আদিবাসী পরিবার।' নবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের সুসজ্জিত বাড়ি 'প্রতীচি' ঘিরে রয়েছে নানাকাহিনী।

বর্তমানে ৩ হাজার ৬০০শ বিঘা (১২০০একর) জমির উপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন গ্রামটিকে গত ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো তাদের ৪৫তম অধিবেশনে 'বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা বছরই শান্তিনিকেতনে উৎসব চলে, তবে ফাগুনের বসন্ত উৎসব এবং প্রচন্ড শীতের পৌষমেলা এখানকার সর্ববৃহৎ এবং আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। এই দুই অনুষ্ঠান ঘিরে দেশ- বিদেশের গুণীজন এবং পর্যটকদের মহামিলনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয় শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি। ১৭ মার্চ ভরদুপুর, এক এক করে সৃজনী শিল্পগ্রামে প্রবেশ করছেন সাহিত্যপ্রেমী ও সাহিত্যসেবীরা। নাট্যকার ও শিশু সংগঠক হিসেবে আমাকে আয়োজকরা অতিথি করেছেন। এবছর আমিই ভিনদেশী অতিথি।অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতভবন বিভাগের অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক কে এস নারায়ণ থিরুভাল্লি। যিনি কেরেলার মানুষ। তিনি বাংলাদেশে বেড়াতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে অর্ধশতাধিক নৃত্যশিল্পীর অংশ গ্রহণে নৃত্যশোভা যাত্রা। এক এক করে পরিবেশিত হয় রাগপ্রধান যন্ত্রসঙ্গীত, নৃত্যনাট্য, বসন্ত, রবীন্দ্র, লোকনৃত্য এবং ভরতনাট্যম। অধ্যক্ষ অর্পিতা বিশ্বাস গ্রন্থিত এবং পরিচালিত উৎসবটি প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন জিনিয়া ব্যানার্জী।পুরো অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা শিক্ষণীয়।

অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক ড. অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়, নৃত্যকলা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক শ্রী বসন্ত মুখোপাধ্যায়, ইজেসিসি শিল্পগ্রামের অফিসার শ্রী অমিত অধিকারী, বিশ্বভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতভবন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ড. কৌস্তভ কর্মকার, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও মিউজিক থেরাপিস্ট শ্রীমতি ঈশিতা মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও গানবাড়ির অধ্যক্ষ ড. অর্পন রক্ষিত ও আন্তর্জাতিক লোক নৃত্যশিল্পী শ্রী সুমন মন্ডল। অনুষ্ঠানে এসেছেন রবীন্দ্র সঙ্গীতের গায়ক, সহচরী নামক এক সঙ্গীতসেবী প্রতিষ্ঠানের প্রবীণ ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ক আলাদা দুটি প্রকাশনার কর্ণধার আশি বছর বয়স্ক শ্রী শ্রীবিন্দু ভট্টাচার্য। যিনি অনুযোগের স্বরে বললেন, "শিল্প -সাহিত্য বিনিময়ে ভারত-বাংলাদেশ মনে হয় এখনও যথেষ্ট পিছিয়ে আছে।" কারণ হিসেবে তিনি জানালেন, "বাংলাদেশের একুশের বই মেলায় ভারতের প্রকাশকদের বই ডিসপ্লে করতে দেয় না।"

অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে অন্যান্য গুণিজনদের সাথে কথা বলেছি, জেনেছি শান্তিনিকেতনের উৎসব ঘিরে এখানকার জনমানুষের জীবনযাত্রার প্রকৃতি ও ধরণ। আলাপচারিতায় স্পষ্ট হয়েছে, সাহিত্য শুধু বিনোদন কিংবা মনের খোরাকই নয়, সাহিত্য মানুষকে সুন্দর, সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখে এবং উপার্জনের সুবিশাল ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরভূম জেলা তথা বোলপুরের লাখো মানুষের বর্তমানে আয়- রোজগারের অন্যতম ক্ষেত্র শান্তিনিকেতন গ্রামটি। কেননা, এই গ্রামকে ঘিরে প্রতিনিয়ত বসছে হাট, মেলা। হচ্ছে গান- বাজনা। তৈজসপত্র থেকে হাতের তৈয়ারি সব কিছুই মিলছে এখানে, নেই আধুনিক যুগের প্লাস্টিকপণ্য।

লেখক : শিক্ষক ও শিশু সাহিত্যিক।