বিষ্ণুপুর পিকেএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে উত্তেজনা, প্রধান শিক্ষক হাসপাতালে

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে দুটি পদে নিয়োগকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বিরাজ করছে। উৎকোচ নিয়ে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চাওয়া কয়েকজনের হুমকি ও মানসিক চাপের শিক্ষার প্রধান শিক্ষক অজয় কুমার মন্ডল অসুস্থ হয়ে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় কুমার মন্ডল জানান, গত ৯ মার্চ তার প্রতিষ্ঠানে একজন ল্যাব এসিসট্যান্ট কাম কম্পিউটর অপারেটর এবং একজন আয়া পদে নিয়োগ বোর্ড বসানো হয়। সেখানে ল্যাব এসিসট্যান্ট কাম কম্পিউটর অপারেটর পদে আট জন ও আয়া পদে ছয় জন পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। তার কোন প্রশ্ন না নিয়েই জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি সহকারি কমিশনার (ভূমি) আজাহার হোসেন সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম টুকুকে নিয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করে পরীক্ষা গ্রহণ করেন। বোর্ডে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাকী বিল্লাহর পক্ষে তার প্রতিনিধি একাডেমকি সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। যদিও পরীক্ষা শেষে তাৎক্ষণিক বাছাইয়ে ল্যাব এসিসট্যান্ট কাম কম্পিউটর অপারেটর পদে শ্যামনগরের পুর্ব দুর্গাবাটি গ্রামের মধুসুধন মন্ডল ও আয়াপদে তাপসী সরদারকে মনোনীত করে সাইফুল ইসলাম বাদে অপর চারজন শীটে সাক্ষর করে চলে যান।
শিক্ষা অফিসারের নিয়োগ বোর্ডে না থাকায় তার সাক্ষর পরে নেওয়ার চেষ্টা ও চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা নতুন পরিপত্র অনুযায়ী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি না দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাদের ১১ সদস্য কমিটিতে বিরোধ তৈরি হয়। বিষয়টি নিয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাজাহান কবীরের কাছে যান তিনি ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য সমীর কুমার মন্ডলসহ তিনজন। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাজাহান কবীর সর্বশেষ পরিপত্র অনুযায়ি নিয়োগ প্রক্রিয়া না হওয়ায় নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য তাকে নির্দেশনা দেন। সে অনুযায়ি তিনি বিষয়টি নিয়ে পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। এরই মাঝে মধুসুধণ মন্ডলকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না মর্মে অভিযোগ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর কুমার দাশ ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকতা বাকী বিল্লাহ গত ২৭ মার্চ সকালে বিদ্যালয়ে তদন্তে আসেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিস্তারিত জেনে পরিচালনা পরিষদের সভা ডেকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হলে তা দ্রুত চুড়ান্ত করার নির্দেশ নতুবা কেন নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে না তা তাকে বিস্তারিত লিখে জানানোর জন্য বলে যান। এরপরই দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদারের ভাই বিদ্যালয়ের করণিক কাম লাইব্রেরিয়ান রাধ্যেশ্যাম সরদার রেজুলেশন খাতাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তার কাছে না দিয়ে নিজের আলমারিতে রেখে দেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়। এরপর থেকে ওই নিয়োগ বৈধ করতে সভাপতি খুলনার একটি কলেজের শিক্ষক ও খুলনায় বসবাসকারি দেবদাস মন্ডল, গোবিন্দ লাল সরদার তার ভাই র্যাধেশ্যামকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন।
নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত না থাকার পরও পরবর্তীতে ফলাফল শীটে সাক্ষর করা উপজেলা মধ্যিমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাকী বিল্লাহ, প্রাথী মধুসুধন মন্ডল, সভাপতি দেবদাস মন্ডল, দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদার তাকে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদার সাবেক এক সভাপতির নাম ভাঙিয়ে কম্পিউটার অপারেটর পদে মধুসুধন মন্ডল এর কাছ থেকে আট লাখ ও স্থানীয় বাসিন্দা এক প্রার্থীর কাছ থেকে নয় লাখ ও আয়া পদে তাপসী সরদারের কাছ থেকে আট লাখ টাকা নিয়ে পরে সভাপতির সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারার মাধ্যমে নিয়োগ বোর্ড বৈধ করার চেষ্টা করেন। এ নিয়ে সভাপতি দেবদাস মন্ডল তার চাচাত ভ্ইা হওয়ার সুবাদে তাকেও নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। কমিটির সাত জন্য সদস্য ঘুষের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে নিয়োগ বোর্ড বাতিলের দাবি করতে থাকেন। এ নিয়ে বিদ্যোৎসাহী সদস্য সমীর কুমার মন্ডল নিয়োগ বন্ধের দাবিতে সভাপতিসহ ২৩ জনকে বিবাদী করে করে কালিগঞ্জ সহকারি জজ আদালতে একটি মামলা দেঃ-১১৯/২৪) দায়ের করেন। এ সংক্রান্ত একটি আদালতের নোটিশ তিনি পেয়েছেন। ৭ মে সকালে মধুসুধন মন্ডল তার বাড়িতে যেয়ে তাকে নিয়োগ না দিলে ফল ভাল হবে না বলে হুমকি দেন।
অজয় কুমার মন্ডল আরো জানান, গত ১১ মে সকাল সোয়া ১০টায় বিদ্যালয়ের করণিক রাধেশ্যাম সরদার তাকে ৭ মে তারিখ সভাপতি সাক্ষরিত একটি চিঠি ধরিয়ে দেন। তাতে চিঠিতে সাক্ষর করা দিন থেকে সাত দিনের মধ্যে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে পরিচালনা পরিষদের সভা আহবানের নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি বিষয়টি নিয়ে সভাপতিকে লিখিত জবাব দেন। সভাপতির অভিযোগক্রমে কোন প্রকার এজেন্ডা ছাড়াই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাকি বিল্লাহ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি তিনি ১৪ মে বিকেলে পান। তাকে ১৬ মে বৃহষ্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় তাকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে হাজির থাকতে বলা হয়।
একপর্যায়ে ১৫ মে রাতে তিনি কালিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শেখ মেহেদী হাসান সুমনের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফেরার সময় দুর্বডাঙা বিলের জেলে পাড়ার মোড়ে পৌঁছালে মধুসুধন মন্ডল, সভাপতি দেবদাস মন্ডল, গোবিন্দ লাল মন্ডলসহ কয়েকজন তার ভাড়ায় চালিত মটর সাইকেলের গতি রোধ করে। বৃহষ্পতিবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে যাওয়ার আগে মধুসুধণ মন্ডল ও তাপসী সরদারের নিয়োগপত্রে সাক্ষর করে না নিয়ে গেলে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। প্রতিবাদ করায় তাকে কিল ও ঘুষি মারা হয়। মধুসুধন ও তপাসীর চাকরি না হলে নিয়োগ বোর্ডের তিন সদস্য এর জন্য ঘুষ বাবদ খরচ ১০ লাখ টাকাসহ গোবিন্দ লাল সরদারের তিন প্রার্থীর কাছ থেকে নেওয়া ২৫ লাখ টাকা তার (অজয়) কাছ থেকে আদায় করার হুমকি দেওয়া হয়। একপর্যায়ে শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে রাতেই স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। ১৬ মে সকালে তিনি সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। ভর্তির বিষয়টি তিনি তার এক আত্মীয়ার মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করেন।
এ ব্যাপারে বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি দেবদাস মন্ডল সাংবাদিকদের বলেন, নিয়োগ নিয়ে উৎকোচ গ্রহণ, অজয় মন্ডলকে হুমকি ও মারপিটের অবিযোগ সঠিক নয়। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটি মহল তাকেসহ গোবিন্দ লাল এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
কালিগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাকি বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, অজয় মন্ডল অসুস্থ হয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মর্মে তিনি শুনেছেন।
কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর দাস বলেন, সভাপতির চিঠি পেয়েও পরিচালনা কমিটির সভা না ডাকার অভিযোগ পেয়ে তিনি প্রধান শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের ১৬ মে সকাল সাড়ে ১১টায় তার অফিসে আসার জন্য চিঠি পাঠান। একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে গড়িমসি করার অভিযোগ রয়েছে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেন তিনি।
(আরকে/এসপি/মে ১৭, ২০২৪)