শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে দিনাজপুরের তিনটি উপজেলায় শেষ মুহূর্তে জমে উঠেছে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। ভোটারদের মন জয় করে সমর্থন আদায়ে প্রার্থীরা দিন-রাত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে  ঘুরছেন। বাসা-বাড়ি, হাটে-বাজারে রাস্তা ঘাটে ভোট প্রার্থনা করছেন। করছেন উঠোন বৈঠক, সভা-সমাবেশ পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ছেয়ে গেছে। হ্যান্ডবিলের ছড়াছড়ি।

আগামীতে ২৯ মে তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দিনাজপুরের সদর,চিরিবন্দর ও খানসামা এই তিনটি উপজেলার নির্বাচন। চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সহ ৩১ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মাঠ চোষে বেড়াচ্ছেন। নিজেদের সমর্থকদের নিয়ে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার পাশাপাশি হাটে-বাজারে, রাস্তা ঘাটেও চলছে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা।

শেষ মুহূর্তে বেড়েছে প্রার্থী আর কর্মী-সমর্থকদের তৎপরতা। যে কোনো মূল্যে ভোটারদের মন জয় করতে তারা ছুটছেন দ্বারে দ্বারে। করছেন জয়ের হিসেব-নিকাশ। অন্যদিকে ভোটাররা হিসেব কষছেন মাঠে কার কি অবস্থা। কে পড়তে পারে শেষ বিজয়ের মালা। প্রার্থীরা তাদের নিজেদের নিয়ে হিসেব কষলেও ভোটাররা হিসেব কষছেন প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীকে নিয়ে। অতীত আর ভবিষ্যত্ নিয়ে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের অঙ্ক কষছেন সাধারণ ভোটাররা। তবে তিনটি আসনেই ভোটের লড়াই হবে দ্বিমুখী।
তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দিনাজপুরের তিনটি উপজেলার ৩১ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মাঠ চোষে বেড়াচ্ছেন।

চেয়ারম্যান পদে ১২ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৯ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১০ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারন হবে আগামী ২৯ মে। পোস্টারে ছেয়ে গেছে দিনাজপুরের তিনটি উপজেলার অলিগলি, ছোট-বড়, রাস্তাঘাট, হাটবাজার, টংয়ের চায়ের দোকান কিংবা যেকোনো প্রতিষ্ঠান সব জায়গায় চলছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আলোচনা-পর্যালোচনা।

খানসামা কাচিনিয়া হাটে শনিবার রাতে কথা হয় ভাবকি গ্রামের মহন্ত লালের সাথে। ষাটোর্ধ বয়সের মহন্ত জানান, ‘এলায় সবাই আইসেছে।ভোট চাহেছে।ভোট ভেরেই গেলে কেহোই আইসেনা। না খাই মরি গেইলেও কেহো খবর নেয়না।আর এখনো ভালো ভালো কথা কহেছে। এইলাক সবাই চিনে। এখন বিপদত পড়ি সবায় দৌড়াছে।হাত-পাও ধরেছে।’

চিরিবন্দর বিন্নাকুড়ি গ্রামে মহেছেনা বেগম জানালেন, ‘বাহে চাহিবা আইছেন। এইবার হামাকেও কিছু দিয়া যাও। আমরা ফ্রি মাংনায় কাউকেও ভোট দিমোনা। ভোটের পর তোমরা কাহোই আইসেন না। এলায় আইছেন, টাকা দিয়া যাও। তারপর ভোট দিমো।’

দুপুর ২টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত চলছে নির্বচনী প্রচারের নিয়ম থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত চলছে নির্বাচনি প্রচারাভিযান, গণসংযোগ। কোনো কোনো প্রার্থী মাইকে গানের মাধ্যমে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। ভোটারদের ২৯ মে ভোট কেন্দ্রে আনার ব্যাপারে পাড়ায় মহল্লায় প্রার্থী ও সমর্থকরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।

ভ্যান চালক কাদের মোল্লা জানালেন, ‘মোর ভ্যানত নির্বাচনের মাইক চলেছে। প্রতিদিন ৫০০ টাকা দেয় বলেই চালাছো। মাইকিং চলেছে, মোর ভ্যানত। এই প্রার্থীর মাইক চলেছে। সেই প্রার্থীক তো মুই এ ভোট দিনেনাহাও। ব্যাটা খাইট্রা। ভালো, মানুষ নাহায়। শুধু টাকার জন্যই খাটেছো।’

দিনাজপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন ৩ জন। বর্তমান চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইমদাদ সরকার (মোটরসাইকেল), বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলাম সোহাগ (আনারস) আর সদর উপজেলা কৃষক লীগের আহ্বায়ক জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ফয়সাল হাবীব সুমন (ঘোড়া)।

ভাইস চেয়ারম্যান পদে ছাত্রলীগ নেতা আহসানুজ্জামান চঞ্চল (চশমা) ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী রিনা কুমারী রায় পারুল (তালা) এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসমিন লুনা (প্রজাপ্রতি) ও আওয়ামী লীগ নেত্রী কুলসুম বানু (কলস) প্রার্থী হয়েছেন।

নুর আলম নামে এক গাড়ি চালক জানালেন, একটাও ভালো প্রার্থী নেই। ভোট দিমো কাকে? তামাম তো দুগগিবাদ। চরিত্র ভালো নাহায়। একজন প্রার্থী নাকি ৬ কোট টাকায় বাড়ি ফ্যাক্টরি বিক্রি করি নির্বাচন করছে। ওই মানুষ নির্বাচনে জিতিলে কি করিবে? জনগণের টাকা দিয়েতো বাড়ি-ঘর বানানে। হারিলে ফকির হই রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করিবে। এইলাক কে ভোট দিবা যাবি। ভোটের দিন বাড়িত খিচুরি পাক করি খামো।বাড়িতেই আনন্দ- ফুর্তি করিমো। ভোট দিবা যাবোনাহি।

চিরিরবন্দর উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৫ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩ জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৫ জন হলেন- উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক সমিতির নেতা মো. আহসানুল হক মুকুল (হেলিকপ্টার), উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সুনীল কুমার সাহা (দোয়াত কলম), বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জোতিষ চন্দ্র রায় (মোটরসাইকেল), উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার (ঘোড়া) এবং বিএনপি’র বহিষ্কৃত নেতা সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মোকারম হোসেন (আনারস)।

৩ জন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হলেন- সুমন দাস (বৈদ্যুতিক বাল্ব), আব্দুল্লাহ আল মামুন (মাইক) ও মো. জামাল উদ্দিন মহুরি (তালা)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ৪ জন হলেন- লায়লা বানু (প্রজাপতি), তরু বালা রায় (কলস), ওয়াজিদা খাতুন বেবি (ফুটবল) ও পূর্ণিমা মহন্ত ছবি (পদ্মফুল)। খানসামা উপজেলায় আওয়ামী লীগের উপজেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ২ জনই ভোট যুদ্ধে মাঠ কাপাচ্ছেন। ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ৪ জন হলেন- বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান এ টি এম সুজাউদ্দিন শাহ লুহিন (উড়োজাহাজ), ধীমান চন্দ্র দাস (তালা), হাজ্জাজ আল হাদী (বৈদ্যুতিক বাল্ব) ও রেজাউল করিম (টিয়া পাখি)। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও ৪ জন প্রার্থী হলেন- পলি রায় (ফুটবল), গুলসান জান্নাত (বৈদ্যুতিক পাখা), মঞ্জিল আফরোজ পারভীন (কলস) ও শারমিন রহমান (প্রজাপতি)।

খানসামা উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে হেলিকপ্টার প্রতীকে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সফিউল আযম চৌধুরী লায়ন, দুই বারের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান শাহ আনারস, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম মোটরসাইকেল ও উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রাকেশ গুহ ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান এটিএম সুজাউদ্দিন শাহ লুহিন উড়োজাহাজ।

উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ধীমান চন্দ্র দাস তালা, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রেজাউল করিম টিয়া পাখি ও উপজেলা যুবলীগ নেতা প্রভাষক হাজ্জাজ আল হাদী বড়বাবু বৈদ্যুতিক বাল্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জিল আফরোজ পারভীন কলস, উপজেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি পলি রাণী রায় ফুটবল, সাংবাদিক সারমিন রহমান প্রজাপতি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী গুলশান জান্নাত সানু বৈদ্যুতিক পাখা প্রতীকে এবার লড়বেন।

তবে ভোটারদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর আগ্রহ তুলনামূলক কম। ৩টি উপজেলায় সবকটি পদে আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। ভোটারদের ২৯ মে ভোট কেন্দ্রে আনার ব্যাপারে পাড়ায় মহল্লায় প্রার্থীদের সমর্থকরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। প্রচার-প্রচারণা চলবে হবে ২৭ মে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আগামী ২৯ মে ব্যালটের মাধ্যমে সকাল ৮ টা থেকে একনাগারে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে।

জেলা নির্বাচন কমিশনার কামরুল হাসান জানিয়েছেন, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু পরিবেশে প্রচার-প্রচারণা ও নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনের সকল নির্দেশনা বাস্তবায়নে প্রশাসন প্রস্তুত রয়েছে। এতে সকল প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটারদের সহযোগিতা প্রয়োজন। যাতে অপ্রীতিকর কোন ঘটনা না ঘটে।

(এসএস/এসপি/মে ২৬, ২০২৪)